08-03-2024 13:10:23 pm
Link: https://ebongalap.org/minority-women-in-public-sphere
তালা-বন্ধ মাঠ। ছেলেদের খেলা হয়ে যাবার পর ‘আর কেউ’ যেন ঢুকতে না পারে, তাই মাঠ বন্ধ রাখাই ‘নিয়ম’। তবু, কুছ পরোয়া নেই! পাঁচিল টপকে একদল মেয়ে ঢুকে পড়ল মাঠের ভেতর। ওরা প্র্যাক্টিস করবে ভলিবল, জাভলিন, সাইক্লিং। একদিন-দুদিন নয়, আজ-কাল-পরশু-রোজ ওরা এভাবেই প্র্যাক্টিস করে যাবে।
নবম শ্রেণির আনিশা ভলিবল খেলে। আনিশা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা। পড়ে দেবকুন্ড আব্দুর রাজ্জাক মেমোরিয়াল গার্লস হাই মাদ্রাসায়। স্কুলের বড়দিমণির হাত ধরে ছোট্ট এই কিশোরী কলকাতায় এসেছে নিজের লড়াইয়ের কথা, ওর সব বন্ধুদের লড়াইয়ের কথা, আর তার চেয়েও বেশি করে ওদের স্বপ্নের কথা সবাইকে বলবে বলে। আর সেটাই বলল ও, স্পষ্ট ভাষায় -
“একটা মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে খেলতে গিয়ে অনেক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে, তবু আমরা লড়াই চালিয়ে যাব, একার লড়াই নয়, গোটা নারীজাতির লড়াই। কারণ শুধু মেয়েমানুষ হয়ে নয়, আমরা বাঁচতে চাই মানুষ হিসেবে।”
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মুসলিম/সংখ্যালঘু মেয়েরা শহরে, গ্রামে, রাস্তাঘাটে, খেলার মাঠে বা অন্য বিভিন্ন জনপরিসরে কী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন সেই নিয়েই গত ২৭ জানুয়ারি কলকাতার ট্যাংরায় ‘আজাদ ফাউন্ডেশন’ এবং ‘নো ইয়োর নেবার’ সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল আলোচনা সভা। উপস্থিত হয়েছিলেন জনপরিসরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার ভুক্তভোগী সংখ্যালঘু মেয়েরা। তাঁদের বাধা-বিপত্তির পাশাপাশি তাঁদের লড়াই আর সেই লড়াইয়ে তাঁদের জয়ের কাহিনি ভাগ করে নিলেন সকলের সাথে।
যেমন আনিশা। প্রধান শিক্ষিকা মুর্শিদা খাতুনের সঙ্গে আসা বেলডাঙা দেবকুন্ড হাই মাদ্রাসার তিন খেলোয়াড় ছাত্রীর একজন। স্কুলের গন্ডিতে, পরিবারে, প্রতিবেশীদের মধ্যে এবং সমাজের অন্যান্য পরিসরে প্রতিদিন কী বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে খেলার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় ওদের, নবম শ্রেণির আনিশা সেই কথা বলে গেল, একবারও না থেমে। কারণ ওর লড়াইটা প্রতিমুহুর্তের, আর প্রতিকূলতাও তো একটা নয়, অসংখ্য – মেয়ে হিসেবে, সংখ্যালঘু হিসেবে, প্রান্তিক হিসেবে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য হিসেবে। তিন ছাত্রীই গোঁড়া মুসলিম পরিবারের। আর্থিক অবস্থা ভাল নয় বলে পরিবারে সাহায্য করার পাশাপাশি স্কুলের পড়াশোনা ক’রে তারপর খেলার অনুশীলনের সময় করে নিতে হয়।
ভালো খেলে ওরা। কিন্তু মেয়েদের খেলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা থাকা তো বিলাসিতা! তাই স্কুলে কোনো মাঠ নেই। অগত্যা, রোজকার প্র্যাক্টিসের জন্য যেতে হয় পাশের ছেলেদের খেলার মাঠে। পাঁচিল টপকে ঢুকতে হয় সেখানে, কারণ মেয়েদের খেলার প্রয়োজন নেই। খেলার নামে নাকি ‘বিনোদন’ করে ওরা! তাই কখনও মাঠে তালা, কখনও জল ঢেলে কাদা করে রাখা, কখনও বা সরাসরি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কাছে অভিযোগ জানিয়ে ওদের প্র্যাক্টিস বন্ধ করে দিয়ে ‘শিক্ষা’ দিতে চায় আশেপাশের সবাই। কখনও কখনও মাঠের অভাবে ট্রেনে চড়ে কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে বহরমপুরে খেলতে যেতে হয় মেয়েদের। আর তারপর, স্বাভাবিকভাবেই, বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেলে জোটে অভিভাবকের বকুনি। সমাজের পরিসরে খেলোয়াড়ের পোশাক পরে বেরোনোর স্বাধীনতাটুকুও নেই আনিশাদের, পরতে হয় সালোয়ার বা স্কার্ট। তারপর মাঠে পৌঁছে ওড়না দিয়ে আড়াল করে ওরা বদলে নেয় জার্সি-হাফপ্যাণ্ট। এত কিছুর পরেও, 'ওই' পোশাকে লোকের চোখে পড়ে গেলেও মহাবিপদ! তখন ছোট পোশাক পরিয়ে ‘নষ্ট’ করে দেবার অভিযোগ ওঠে স্বয়ং প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধেই।
জনপরিসরে সংখ্যালঘু মেয়েদের সত্যিটা এটাই। এবং শুধু গ্রামে নয়, শহরেও ছবিটা অনেকটাই একরকম। হয়ত প্রতিকূলতার ভাষাটা অন্য, প্রতিরোধেরও। কলকাতার থিয়েটার কর্মী গুলশন আরা-র কথায়, এই ‘মাইনরিটি’ অবস্থা দুটো স্তরে কার্যকরী – প্রথমত মহিলা হিসেবে, এবং দ্বিতীয়ত মুসলিম হিসেবে।
তাঁর স্বপ্নের জগত, নাটকের জগত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গুলশন আরা বলেন, থিয়েটারের মঞ্চে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়েদের দেখা যায় নি, এটা শুধুমাত্র পারিবারিক রক্ষণশীলতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়, এর কারণটা ঐতিহাসিক। পাবলিক স্পেসে, এক্ষেত্রে পারফরমেন্স স্পেসে, মুসলিম মেয়েদের কম উপস্থিতির কারণ হিসেবে তিনি বাংলায় প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ইতিহাসের সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্তর্লীন সম্পর্কের বিষয়টি নজরে আনেন। যেখানে কোনো ‘মাইনরিটি’কেই জায়গা দেওয়া হয়নি - “তাই নটী বিনোদিনী বা তারাসুন্দরীর পাশে কোনো ‘গুলশন আরা’দের কথা শোনা যায়নি।” কিন্তু তার মানে পারফরমেন্সের দুনিয়ায় মুসলিম মেয়েরা যে অনুপস্থিত তা কখনই নয়। গুলশন বললেন, যাত্রা, পালাগান ও এরকম আরো অনেক ব্রিটিশের দেওয়া ‘মার্জিনালাইজড’ তকমা-র পারফরমেন্স-এ মুসলিম মেয়েরা নানাভাবে অংশগ্রহণ করে এসেছে চিরকাল। তাই গুলশনের মতে, ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতা আর দূরত্ব ও প্রতিকূলতা দূর করতে চাইলে দরকার পাশের মানুষগুলোকে জানার, ভুল ধারণা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে না রেখে, এড়িয়ে না গিয়ে বরং তাদের সাথে কথা বলে, সঠিকভাবে একে অপরকে জেনে নিলে অজ্ঞানতা আর প্রতিকূলতার এই চেহারাটা বদলাবে।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ না জেনেই কীভাবে আরো বেশি পিছিয়ে দেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে, কীভাবে তাঁদের মনের জোর আর লড়াই করার শক্তিকে কমজোরি করে দেন সঠিক ধারণার অভাবে, বিরূপ মন্তব্যের মাধ্যমে, পাশের মানুষটাকে না চেনার কারণে - এই নিয়ে কথা বললেন রহিমা খাতুন। হাওড়ার বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন রহিমা। তাঁর কথায়, পরিবারের পরিসরে সংখ্যালঘু মেয়েদের প্রতিকূল পরিস্থিতির চিত্রটা এখন অনেকটাই বদলেছে।
কারণ পরিবারের মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে আসা, শিক্ষিত হওয়া, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ এখন অনেক বেশি। আগে এই সামান্য অধিকারটুকুর জন্যও অনেক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। পরিবারের পরিসরে এই মানসিকতাটা পাল্টেছে, কিন্তু জনপরিসরে সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি আচরণ ও মানসিকতার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। ‘মুসলমানরা নোংরা হয়’, ‘ওদের কোনো শিক্ষা নেই’, ‘মুসলমানগুলো তো ট্রেনে টিকিট কেটে ওঠে না’ – এরকম টুকরো মন্তব্য, বিরূপ আচরণ দ্রুত বদলানো দরকার। রহিমা নিজেই তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন, ‘তোমার নাম তো রহিমা; তুমি বাংলা বলতে পার? বাড়িতে কীসে কথা বল? উর্দুতে নিশ্চয়ই!’
আমরা দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করেও পাশের মানুষটার ভাষাকে সন্দেহ করি। সেই একই ভাষায় তাকে লাঞ্ছনা করি। তাই আরো বেশি করে দরকার এমন খোলাখুলি আলোচনা - সমাজের সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু মানুষ, সংখ্যালঘু মেয়েরা যেখানে তাঁদের প্রতিরোধের ভাষ্য ব্যক্ত করতে পারে। রহিমা, আনিশা, মুর্শিদা বা গুলশন আরা প্রতিদিন প্রত্যেকটা পরিসরে যে লড়াইটা লড়ছেন, সেটা ‘ওদের’ লড়াই নয়। আমাদের সকলের লড়াই। কারণ, কোনো না কোনো দিক থেকে আমরা প্রত্যেকেই তো সংখ্যালঘু।
Link: https://ebongalap.org/minority-women-in-public-sphere