08-03-2024 19:26:39 pm
Link: https://ebongalap.org/moral-policing
ঘটনা ১
গত জুলাই মাসের ঘটনা। কলকাতার গর্ব শিল্পসংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র নন্দন চত্বরে, যেখানে ইদানিংকালে সারা বছরই বিভিন্ন উৎসবের ধুম লেগে থাকে, এক রবিবার সন্ধেবেলা সিগারেট খাচ্ছিল বলে দুই তরুনীকে ঘিরে ধরে ‘লিঞ্ছিং’-এর থ্রেট দেওয়া হয়। এবং তা সংগঠিত হয় পুলিশের দায়িত্বশীল অফিসারের নেতৃত্বে। তিনজন বসে যখন গল্প করছিল তখন একজন এসে তাদেরকে ‘গাঁজা খাচ্ছ’ বলে চার্জ করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে নন্দন চত্বরে ভারপ্রাপ্ত পুলিশকর্মী সাদা পোশাক পরিহিত ‘মুখার্জীদা’-কে ডেকে আনেন। অফিসার ও তাঁর সাগরেদদের হাঁকডাকে চোখের নিমেষে একটি গ্যাং তৈরি হয়ে যায়। এরপর ওই দুই তরুণী ও তাঁদের বন্ধুর ওপর শুরু হয় শাসানি। অফিসারবাবু তাদের ‘গাঁজা ব্যবসায়ী’ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং ব্যাগ তল্লাসির নির্দেশ দেন। উল্লসিত গ্যাংটির কয়েকজন পুলিশ অফিসারের এই নির্দেশ কার্যকর করে। কিন্তু ব্যাগে কিছু না পাওয়ার পর তাদের চরিত্র নিয়ে নানা কটূক্তি, হেনস্থা শুরু হয়। এরপর ঠেলতে ঠেলতে তাদের বের করে দেওয়া হয় নন্দন চত্বর থেকে। পুরো সময় জুড়ে বারবার উক্ত পুলিশ অফিসার বলতে থাকেন যে তিনি না থাকলে ‘সাধারণ মানুষই উচিত শিক্ষা দিত’। অর্থাৎ মুখরা মেয়েদের হেনস্থা ও লিঞ্চিংকেই তিনি উচিত ও স্বাভাবিক মনে করেন। ওই তরুণীরা অত্যন্ত বিপন্ন বোধ ক’রে ওই অফিসারের কাছেই নিরাপত্তার দাবি জানায় এবং বলে যে তাদেরকে যেন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাদের এই কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মেয়েগুলি এরপর যখন হেস্টিংস থানায় গিয়ে সেই ‘মুখার্জীদা’-র বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে যায় তখন প্রথমে থানা এফআইআর নিতে চায় না এবং অভিযোগকারীদেরই বিভিন্ন নীতিকথা—সিগারেট খাওয়া কেন মন্দ ইত্যাদি শিক্ষা দিতে শুরু করেন।
এই ঘটনা আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন হাজির করে।
ঘটনা ২
এই বছরেরই জুন মাসের গোড়ার দিকের ঘটনা। দুই তরুণী রাত এগারোটা নাগাদ গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে আউট্ট্রাম ঘাটে গঙ্গার পাড়ে পাবলিক ইউরিনাল খুঁজছিলেন। পাবলিক ইউরিনাল তালাবন্ধ থাকায় পাশের পুলিশ বুথে সাহায্যের জন্য যান তাঁরা। সাহায্য দূরস্থান, পাহারাদার পুলিশেরা তাদের বিদ্রূপ করে এবং খোলা জায়গাতেই প্রস্রাব করতে বলে। পুলিশের সঙ্গে দু’জনের তর্ক বেধে যায়। পুলিশ তাদের বলে যে খোলা জায়গায় মেয়েদের প্রস্রাব করা দেখে তারা যৌন সুরসুরি পেতে চায়। স্বভাবতই মেয়ে দুটি চুপ না করে প্রত্যুত্তর দেয়। কিন্তু সামান্য দুটি মেয়ে তো আর ক্ষমতাশালী পুলিশ-পুরুষের মুখে মুখে তর্ক করে পার পেয়ে যেতে পারে না! নেশা করে গাড়ি চালানো এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে মেয়ে দুটিকে গ্রেফতার করা হয় এবং সাত দিনের জেলও খাটতে হয়। আশার কথা হলো, জেল থেকে বেরিয়ে এসে তারা হাইকোর্টে পালটা মামলা করে। হাইকোর্ট রায় দেয় যে তাদের দুজনকে ভুয়ো মামলায় জড়ানো হয়েছিল এবং পুলিশ নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য তাদের মদ্যপ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। মেয়েদের সিগারেট বা মদ খাওয়া নিয়ে সমাজে যে বিধি-নিষেধ বা ট্যাবু আছে তাকেই কাজে লাগিয়েছিল এই পুলিশরা।
ঘটনা ৩
২০১৬ সালের ঘটনা। বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে দক্ষিণ কলকাতায় পল্লিশ্রীর মতো জায়গায় এক যুবক এবং এক যুবতীকে প্রকাশ্যে মারা হয় ও হেনস্থা করা হয় এই অপরাধে যে যুবতী ছোট প্যান্ট পরে সিগারেট ফুঁকছিল। মেয়েটিকে বলা হয় যে ‘এটা ভদ্রলোকের পাড়া, এখানে ওসব চলবে না’। এই ঘটনার অভিযোগ জানাতে গেলে প্রাথমিকভাবে থানা এফআইআর নিতে অস্বীকার করে। পরবর্তীতে কিছু আন্দোলনকর্মী পাশে দাঁড়ানোর পর পুলিশ চাপে পড়ে এফআইআর নেয়।
ঘটনা ৪
দক্ষিণ কলকাতার বাঘা যতীন অঞ্চলে একটি মেয়ে রাত্রি ১১টায় পাড়ায় ফিরছিল। এত রাত্রে ফেরার ‘অপরাধে’ পাড়ার কিছু ছেলে তাকে প্রথমে বকাবকি শুরু করে এবং মেয়েটি প্রতিবাদ করলে তাকে রাস্তায় ফেলে মারতে থাকে। পাড়ার স্বঘোষিত দাদাদের দ্বারা আক্রান্ত হয় মেয়েটি।
এরকম বহু ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। খবরেরকাগজ খুললে বা ইন্টারনেটে খুঁজলে আরও অনেক ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে। কোথাও প্রেম বা সহবাস করার জন্য, কোথাও সমকামী ইচ্ছা প্রকাশের জন্য, আবার কোথাও শুধুমাত্র রূপান্তরকামী হওয়ার জন্যেই নীতি-পুলিশদের হামলার মুখে পড়ছেন এরাজ্যের সাধারণ মানুষ। এই অভিজ্ঞতার জন্য কর্ণাটকে বা হরিয়ানায় যেতে হবে না। মেয়েরা যেহেতু বিভিন্নভাবে সমাজে মাথা উঁচু করে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে, মর্যাদা ও সমানাধিকার দাবি করছে, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই নীতি পুলিশগিরিও পশ্চিমবঙ্গের পাড়ায় পাড়ায় বেড়ে চলেছে।
আমরা যারা মহিলাদের সমানাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছি, আমাদের বক্তব্য একটাই—যে এ শহরে বা সারা দেশে মহিলারা যে শুধু ধর্ষণ বা পারিবারিক হিংসার শিকার হচ্ছেন তা-ই নয়। আজ যখন মেয়েরা বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরে বেরোতে চাইছে, বহুবছরের বিধিনিষেধের বেড়াজাল থেকে বেরোতে চাইছে, তখন মেয়েদের ওপর বাড়ছে সংগঠিত আক্রমণ—পরিবার, রাষ্ট্র ও পাড়ার দাদাদের। তাদের ওপর নজরদারি, বিধিনিষেধ বা অন্য কথায় বলা যায় নীতিপুলিশির বাড়বাড়ন্ত খুবই চোখে পড়ছে।
নীতিপুলিশ বলছি কেন? যে মেয়েরা সমাজের গভীরে প্রোথিত নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর নৈতিক শিক্ষাগুলিকে ভেঙে বেরোতে চায়, তাদের সমাজের চোখে অপরাধী হিসেবে প্রতিপন্ন করে বিভিন্নভাবে অপদস্থ ও হেনস্থার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে তৎপর হয়ে ওঠার নামই নীতিপুলিশি। পরিবার-পাড়া-ক্যাম্পাস-পার্ক সর্বত্র এই নীতিপুলিশি চলে। ‘লছমনরেখা’ যারা অতিক্রম করছে বা করার মনোভাব দেখাচ্ছে, তাদের শাস্তি দিয়ে সমগ্র নারী জাতির কাছেই বার্তা পাঠান হয় ‘সঠিক ভাবে চলার’। সর্বত্রই পুলিশ প্রশাসন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই নীতিপুলিশিকে সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষণ করে, এবং বহুক্ষেত্রে এরা নিজেরাই আইনি গন্ডি অতিক্রম করে ‘বিপথগামী’ মেয়েদের ওপর উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
২০১৪ সালে যখন কলকাতা শহরে কোচি থেকে শুরু হওয়া ‘কিস অফ লাভ’ আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌঁছয়, তখন সমস্ত ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকেই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা কথা শুনেছিলাম। নানারকম প্রচার চলেছিল আন্দোলনের ফর্ম নিয়ে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত নেতানেত্রীদেরও অনেককেই চরম অস্বস্তিতে পড়তে দেখেছি। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি প্রকাশ্য রাজপথে মেয়েদের উদ্যোগে প্রতিবাদী গণচুম্বন কর্মসূচী। তারা বলতে থাকে যে এটা কখনই প্রতিবাদের ফর্ম হতে পারে না। অনেকে এরকম বলতে চেয়েছিলেন যে কর্ণাটক, হরিয়ানা, পাঞ্জাবে যেখানে সঙ্ঘ পরিবারের বাড়বাড়ন্ত সেখানে ছেলেমেয়েদের মেলামেশার উপর হামলা হয় কিন্তু কলকাতায় তো সেভাবে হয় না। তাই কলকাতায় এরকম আন্দোলন ঠিক নয়। কিন্তু এর বছর দুয়েকের মধ্যেই কলকাতাতেও ‘রোমিও স্কোয়াড’ সামনে আসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ঘটনায়। কলকাতা শহরে কিছু ঘটনা আমরা দেখতে পেয়ে থাকলেও, বহু ঘটনা অগোচরেই থেকে গেছে।
সমাজে মহিলাদের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি স্থির করা আছে। তার বাইরে গেলেই বিপদ। পরিবারের নিয়ম লঙ্ঘন করলে পিতা বা স্বামী শাসন করেন, মেয়েদের মারধর করেন, আবার কখনো সম্মান রক্ষার্থে হত্যা করতেও পিছপা হন না। একই যুক্তিতে পাড়ারও কিছু নিয়ম-নীতি আছে, নন্দন চত্বর সংস্কৃতির পীঠস্থান—তারও নিয়ম-নীতি আছে, মেয়েরা তা ভাঙলে তাদের নীতিশিক্ষা জরুরি, এবং তার জন্য একটু জোর খাটানো যেতেই পারে—এই কথা অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন।
একটি সার্ভে থেকে জানা গেছে দেশে ৩৪- ৩৮ শতাংশ মানুষ মনে করে স্ত্রী যদি স্বামীর কথা না শোনে তা হলে সেই স্ত্রীকে মারধর করাই ন্যায়সঙ্গত। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা নিরন্তর পুনরুৎপাদিত হয়। ভারতে জাতপাত ব্যবস্থা টিকেই থাকবে না যদি মেয়েরা প্রেম ও বিবাহ অর্থাৎ নিজের শরীর ও গর্ভের ওপর নিজের ইচ্ছা কায়েম করার স্বাধীনতা পায়। আজ বিভিন্ন দলিতশ্রেণী জাতবর্ণ ব্যবস্থার নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে সংগ্রাম করছে। জাতধর্ম নির্বিশেষে মেয়েরাও নির্ভয় স্বাধীনতার দাবি তুলছে। এইসব ভারতীয় পুরুষতন্ত্রকে, যা যুগযুগ ধরে নারী ও শুদ্রদের চরম অবদমন ও শোষণের এক সুব্যবস্থিত ধর্মসংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। ফলত বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপে আক্রমণের মাত্রা বাড়ছে। নীতিপুলিশি সেই আক্রমণেরই স্থানীয় বহিঃপ্রকাশ।
জাতপাত বিনাশের প্রশ্নই হোক বা সাম্প্রদায়িক মিলমিশের প্রশ্ন—উভয় ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারীর স্বাধীনতার প্রশ্ন মুখ্য যোগসূত্র হয়ে যায়। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই হিন্দুত্ববাদীরা নারীর যৌনতা নিয়ে সমাজে বিদ্যমান উদ্বেগকে কাজে লাগায় এবং জাত ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনে সম্পর্কগুলোর সামাজিক পুনরুৎপাদন করে। তাই গণতন্ত্র ও নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াইকে যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তা হলে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে এইসব নীতি পুলিশদের মোকাবিলা করেই।
Link: https://ebongalap.org/moral-policing