12-07-2024 10:41:29 am
Link: https://ebongalap.org/muslim-women-in-movement-against-nrc
এবছর বইমেলা যাওয়া হল না। মরসুমের বেশ কয়েকটা বিয়েবাড়িও মিস হল। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। কাজের পর তড়িঘড়ি মন ছোটে কোনদিন পার্কসার্কাসে, কোনদিন খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কে, কোনদিন রাজাবাজার। মনে হয়, বসে থাকি তারান্নুম, জামিলাদের পাশে। শিখি ওদের থেকে সাহস কাকে বলে। কাকে বলে আন্দোলন।
১
কলকাতায় তিন-চার জায়গায় মুসলিম মেয়েরা ধর্নায় বসেছেন। দাবী—নয়া নাগরিকত্ব আইন বাতিল করতে হবে। প্রথম যেদিন পার্ক সার্কাস গেলাম, মনে হল বোরখা পরা মেয়েদের জনসমুদ্র। ছেঁড়া তেরপল, চাটাই পেতে দড়ির বাউন্ডারি টেনে তার মধ্যে মেয়েরা বসেছেন সিএএ-র বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, ভারতবর্ষের পতাকা নিয়ে। তখনও ওদের মাইক্রোফোন ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। মেয়েরা বললেন, টয়লেটের খুব অসুবিধে। মসজিদে টয়লেট ব্যবহার করতে দিচ্ছে, তাই রক্ষে। মাথার ওপর ছাউনি ছিল না।
- এই ঠান্ডায় ছাউনি ছাড়া সারারাত পার্ক সার্কাস ময়দানে থাকছেন, শীত করছে না?
বোকার মত প্রশ্ন করি আমি। উত্তর পাই,
- কি করব দিদি, আমাদের যে দেশছাড়া করবে বলছে। কোথায় যাব আমরা!আমাদের তো রাত জাগতেই হবে।
আবারও বোকা প্রশ্ন করি,
- কিন্তু সারাদিন-রাত এখানে বসে থাকছেন—বাড়ির কাজ, রুটিরুজির কাজ, কিভাবে সামলাচ্ছেন? রশিদা উত্তর দেন,
- ঐ দিনে একবার বাড়ি যাই, কোনরকমে কিছু সামলে আসি। বাড়ির পুরুষরাও ঘরের কাজের অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন।
আচমকা মনে হল, সেকি! তাহলে মুসলমান পুরুষরা শুধু স্ত্রীদের তালাক দেন এবং ঘরবন্দী ক’রে রাখেন না! ঘরের কাজে, বাচ্চা দেখায় সাহায্যও করেন! শুধু আমাদের মত উচ্চ বর্ণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এবং আমাদের রাষ্ট্রেরই সেসব চোখে পড়ে না!
"
মুসলমান মেয়ে = স্বধর্মের পুরুষের দ্বারা শিকলবন্দী,
আমাদের চিন্তায় এই একমাত্রিক সমীকরণটি বদলানোর সময় এসেছে
"
পার্কসার্কাসে কিন্তু অনেক পুরুষও ছিলেন। দড়ির ভিতরেও। কয়েকদিন যেতে যেতে বুঝলাম, আসলে উদ্যোক্তারা দড়ির ভিতরে, পরবর্তীকালে বাঁশের বেড়ার ভিতরে যাওয়ার অধিকার পান। যেহেতু মেয়েরাই এই প্রতিবাদের মূল উদ্যোক্তা, সেহেতু বেড়ার মধ্যে বেশী মেয়ের উপস্থিতি চোখে পড়ে। ‘দড়ির ভিতর মেয়েরা কেন’, এইসব শৌখিন প্রশ্ন যখন আমাদের দল, অর্থাৎ সুবিধাভোগী, হিন্দু উচ্চ বর্ণের অধিকার-আন্দোলন কর্মীরা তুলছেন, তখন তাদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই, যেকোনও বড় সভাতেই সাধারণত কর্ডন থাকে, বাঁশের বেড়ার মধ্যে দিয়ে এমনকী রাষ্ট্রনেতারাও মিছিল করেন, ঘেরাটোপের মধ্যে তাঁদের সভার মঞ্চ থাকে।
সুতরাং, মুসলমান মেয়ে = স্বধর্মের পুরুষের দ্বারা শিকলবন্দী, আমাদের চিন্তায় এই একমাত্রিক সমীকরণটি বদলানোর সময় এসেছে। পার্কসার্কাসে আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করা গেল যে, মেয়েদের যেমন কোনও একমাত্রিক পরিচিতি হয় না, তেমনই মুসলমান মেয়েদেরও কোনও একমাত্রিক পরিচিতি হয় না। ভাষা, বাসস্থান, পেশা, শ্রেণী অনুসারে একই ধর্মীয় পরিচিতির মেয়েদের মধ্যেও নানা আলাদা আলাদা পরিচিতি আছে। পার্কসার্কাসে কিন্তু প্রায় সমস্ত অবস্থানের মুসলিম মেয়েরা সমবেত হয়েছেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা থেকে শুরু করে পিলখানার গার্হস্থ্য শ্রমিক, চার মাসের বাচ্চার মা থেকে অশীতিপর বৃদ্ধা, সদ্য কলেজপড়ুয়া এবং তাদের মায়েরা সকলেই নিজেদের শ্রেণীগত অবস্থান ভুলে প্রথমে চাটাই, পরে মোটা শতরঞ্চিতে পাশাপাশি ঠাঁই করে নিয়েছেন। সকলেরই একই দাবী—এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বাতিল করতে হবে। শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের যে কদর্য রাজনীতি ভারতবর্ষের সরকার করতে চাইছেন, ধর্মীয় পরিচিতি আঁকড়েই তার যোগ্য জবাব দিতে পথে নেমেছেন মুসলমান মেয়েরা।
মোমিনপুরের নবাব আলি পার্কের চিত্র একটু অন্যরকম। পার্ক সার্কাসের তুলনায় প্রথমদিকে জমায়েত একটু কম থাকলেও, ক্রমশ দিনে দিনে জমায়েত বাড়তে থাকে। এখানে পার্ক সার্কাসের তুলনায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি অবশ্য কম। পার্ক সার্কাস ময়দানের অবস্থানগত সুবিধে তার জন্য আংশিক দায়ী, আর আংশিক কারণ বোধহয় খিদিরপুর, মোমিনপুরের সামাজিক প্রান্তিকতা। সমাবেশে জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণে অনেক বেশী সংগঠিত ধর্না চলছিল নবাব আলি পার্কে। পার্ক সার্কাসের তুলনায় নবাব আলি পার্কে শুরুর দিকে মেয়ে বক্তার সংখ্যা কম দেখা গেছে। আসলে মাইকে কথা বলা এক বিশেষ দক্ষতা, যে মুসলিম নেত্রীরা পার্ক সার্কাস অঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, আঞ্চলিক এবং শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই সম্ভবত তারা মাইকে কথা বলতে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ ছিলেন। এখানেও নবাব আলি পার্কের মুসলমান পুরুষদের ভিলেন বানানোর চেষ্টা না করাই বাঞ্ছনীয়। এ প্রসঙ্গে প্রশংসনীয় হল, তরুণ প্রজন্মের মুসলমান মেয়েদের নিজেদের মধ্যে কোঅর্ডিনেশন। যখনই নওসিন, আফরিনরা দেখলেন পার্কসার্কাসে মহিলা বক্তার অভাব নেই, কিন্তু নবাব আলি পার্কে মহিলা বক্তা প্রয়োজন, তখনই দেখলাম তারা পালা করে পার্ক সার্কাস থেকে মোমিনপুর ছুটতে লাগলেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই আন্দোলনে তরুণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, পিএইচডি ছাত্রী, শিক্ষিকা এবং পেশাদার মুসলিম নারীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতন। শুধু অংশগ্রহণই নয়, তারা যেভাবে আন্দোলনকে রাজনৈতিক দিশা দেখাচ্ছেন, বাম-ডান সব দলের কবল থেকে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলছেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। একইসঙ্গে তারা আন্দোলনের মধ্যেকার পিতৃতান্ত্রিক ঝোঁকগুলিকেও আটকানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
"
প্রশংসনীয় হল তরুণ প্রজন্মের মুসলমান মেয়েদের নিজেদের মধ্যে কোঅর্ডিনেশন
"
রাজাবাজারের চিত্রটি আবার একটু অন্যরকম। সাহিনার মত নেত্রী থাকার ফলে এখানে বক্তা হিসেবেও মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশী। রাজাবাজারে ধর্নার জায়গাটা একটি লম্বাটে, বড় রাস্তার ওপর। এখানেও জমায়েত অনেক সংগঠিত। পার্ক সার্কাস এবং রাজাবাজারে বহু মহিলা কলকাতার এবং হাওড়ার বিভিন্ন জায়গা থেকেও এসেছেন। কিন্তু নবাব আলি পার্কে মূলত খিদিরপুর, মোমিনপুর অঞ্চলের মেয়েদেরই ভিড়।
শনি-রবিবার পার্ক সার্কাসে লোক উপচে পড়ে। অন্তত শুরুর দিকে তা-ই হচ্ছিল। বিভিন্ন পাড়ার মুসলমান মানুষ, মূলত মেয়েরা, মিছিল ক’রে সমাবেশে এসে পৌঁছচ্ছিলেন। যারা পেশার কারণে সারা সপ্তাহ আসতে পারেন না, তারা শনি-রবিবার আসেন। অনেক মহিলা বলছিলেন, রবিবার স্বামী ধর্নায় এসেছেন ব’লে তিনি বাড়িতে একটু বিশ্রাম করেছেন। অনেক শাশুড়ি-বৌমাও পালা ক’রে ধর্না মঞ্চে বসছেন। পার্কসার্কাসে অনেক অ-মুসলিম মানুষও যাচ্ছেন। কিছু মানুষ যেমন ফেসবুকে ছবি দেওয়ার জন্য যাচ্ছেন, যার আধুনিক নাম ‘প্রোটেস্ট ট্যুরিসম’, তেমনই কিছু মানুষ অন্তর থেকেই সমর্থন এবং সহমর্মিতা জানাতে ধর্না মঞ্চে উপস্থিত হচ্ছেন।
"
যে আন্দোলনের মূল ভিত ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাগরিকত্বের অধিকারের জন্য প্রতিরোধ,
সেই আন্দোলনকে শুধুমাত্র ‘মহিলা আন্দোলন’ বলে সরলীকরণ করা যায় না
"
এই আন্দোলনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে একটা কথা বলা জরুরি যে, এই আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মেয়েরা। অনেক নারীবাদী নেত্রী একে মেয়েদের আন্দোলন বলছেন, আলাদা ক’রে মুসলিম মেয়েদের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করছেন না। আমার মতে, এই চিহ্নিত না-করা খুবই সমস্যাজনক। পার্কসার্কাসের মঞ্চ থেকে শুধু ‘মহিলা একতা’ বলে স্লোগান দিলে নারী আন্দোলনের মধ্যেও যে বিভিন্ন গোষ্ঠী পরিচিতির লড়াই থাকে, বহুস্বরের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তাকে অস্বীকার করা হয়। আর এই অস্বীকারের ফলে ক্রমশ ইতিহাসের খাতায় সংখ্যালঘু মেয়েদের লড়াই হারিয়ে গিয়ে সেই সুবিধাভোগী উচ্চ বর্ণের মেয়েদের লড়াইয়ের সঙ্গে এই আন্দোলনকে এক করে দেওয়ার ঝুঁকি থাকবে।আমেরিকার ইতিহাসে যেমন সাদা মেয়েদের আন্দোলনের আধিপত্য, আমাদের দেশেও যেমন সাবিত্রীবাই ফুলে, ফতিমা শেখ, বেগম রোকেয়ার থেকে লোকে বেশী জানে বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত, সরোজিনী নাইডু, লক্ষ্মী সাহগলের নাম, তেমনই আজকের নাগরিকত্বের আন্দোলনেও মুসলমান মেয়েদের নেতৃত্বের কথা আলাদা করে উল্লেখ না করলে তা হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা। অবশ্যই বিজয়লক্ষ্মী, সরোজিনী, লক্ষ্মী সাহগলদের অবদান স্মরণে রাখতে হবে, কিন্তু ফতিমা শেখ, সাবিত্রীবাইয়ের নামও উচ্চারিত হওয়া দরকার একই নিশ্বাসে। মনে রাখা দরকার এদেশে হিন্দু উচ্চবর্ণের নারী রাজনৈতিক কর্মীকে শুধু নারী হওয়ার কারণে রাজনৈতিক পরিসরে জায়গা দখলের লড়াই লড়তে হয়েছে,আর তথাকথিত ‘ছোট জাতের’, মুসলমান মেয়েদের মেয়ে হিসেবেও লড়তে হয়েছে, আবার জাত-ধর্মের পরিচিতির কারণেও লড়তে হয়েছে। সাবিত্রীবাই, রোকেয়াদের লড়াই দ্বিমাত্রিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখনও ইতিহাসের সেই ধারাই চলছে। মেয়েদের আন্দোলনের মধ্যে যদি আমরা আলাদা আলাদা পরিচিতির আন্দোলনকে সমান গুরুত্ব না দিই, তাহলে নারী আন্দোলনও উচ্চ শ্রেণী, বর্ণ এবং সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের শিকার হবে। বিশেষত, যে আন্দোলনের মূল ভিত হল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাগরিকত্বের অধিকারের জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সেই আন্দোলনকে তো কিছুতেই ধর্মীয় পরিচয় ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র ‘মহিলা আন্দোলন’ বলে সরলীকরণ করা যায় না।
২
পার্ক সার্কাস, নবাব আলি পার্ক, রাজাবাজার সর্বত্র এই আন্দোলনের এক আশ্চর্যজনক গতিধারা নজরে পড়ে। যে লড়াই শুরু হয়েছিল নিজেদের সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকারের দাবীতে সেই লড়াই ক্রমশ সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে মোড় নিল। সংবিধানের ১৪নং ধারা অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচানোর বৃহত্তর দাবী তুললেন ধর্নায় বসা মুসলমান মেয়েরা। একদিকে যেমন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংযোজন, অন্যদিকে ধর্মীয় পরিচিতির উর্ধ্বে উঠে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার এই তাগিদ কি কোনও গভীরতম অনিশ্চয়তার আভাস দেয়?
বহু প্রজন্ম ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এবং ভারতরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণ করার যে অভ্যাস এদেশের মুসলমান সমাজ বহন করছেন, সরস্বতী পুজোর ফল কেটে যেমন নিজেকে ‘ভালো মুসলমান’ প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন (উল্টোদিকে ‘প্রগতিশীল’ চাটুজ্যে, বাঁড়ুজ্যে, গাঙ্গুলিদের বাড়িতে ঈদে সেমুই বানাতে কখনো দেখা যায় না), এই আন্দোলন মঞ্চেও কি নেত্রীদের মনের অবচেতনে সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটল?
"
পরিচিতির আন্দোলন এবং উচ্চবর্ণের মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত নারী আন্দোলন
কোনদিন একই বিন্দুতে মিলবে না, দুটো সমান্তরাল ধারা চলতে থাকবে,
যার ফলে সুবিধা হবে রক্ষণশীল এবং বিভেদকামী সমাজের, রাষ্ট্রের।
"
পার্ক সার্কাস ময়দানে যখন বুক কর্ণার চালু হল, তখন প্রথম যে ধর্মগ্রন্থটি দান হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল সেটি ছিল কোরান। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত গীতা, বাইবেল, গ্রন্থসাহেব পাওয়া যায়নি, ততক্ষণ অবধি উদ্যোক্তারা কোরানটি বইয়ের জায়গায় রাখতে পারেননি। কেন আন্দোলনের মঞ্চেও নিজেদের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এত সঙ্কুচিত থাকতে হবে মুসলিম মহিলাদের? কেন নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতি জাহির করতে এত কুন্ঠা তাদের? এর দায় কি আমাদের ওপর পড়ে না? আমরা যারা নানা অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করি, তারা কখনো মুসলমান মেয়েদের, দলিত মেয়েদের আন্দোলনের পরিসরে এই কুন্ঠাবোধ কিভাবে কাটানো যায় তার কোনও উদ্যোগ নিয়েছি? আজও যখন মুরুব্বিচালে পার্ক সার্কাস, কিম্বা নবাবআলি পার্কে অথবা রাজাবাজারে যাই, তখনও বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি দিয়ে আন্দোলনকে বিচার করছি, পাশে দাঁড়াচ্ছি কই? সত্যিই যদি পাশে দাঁড়াতে চাই্তাম তাহলে কি এতদিনে আমরা এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ পার্ক সার্কাস ময়দানের সামিদা খাতুনের স্মরণে হাজরা মোড়, যাদবপুর অথবা শ্যামবাজারে একটা সভা ক’রে উঠতে পারতাম না? আমরা, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু, উচ্চবর্ণের আন্দোলনকর্মীরা, যদি নিজেদের এই দায় স্বীকার না করি, সচেতনভাবে আন্দোলনের পরিসরে বিন্যাস বদলের উদ্যোগ না নিই, তাহলে আন্দোলনের মধ্যে সুবিধাভোগী মানুষের আধিপত্য কোনদিন দূর হবে না। পরিচিতির আন্দোলন এবং উচ্চবর্ণের মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত নারী আন্দোলন কোনদিন একই বিন্দুতে মিলবে না, দুটো সমান্তরাল ধারা চলতে থাকবে, যার ফলে সুবিধা হবে রক্ষণশীল এবং বিভেদকামী সমাজের, রাষ্ট্রের।
"
যে তারান্নুম প্রথমদিন ধর্না মঞ্চে এসেছিলেন
আর যে তারান্নুম আন্দোলন শেষে বাড়ি ফিরবেন,
দুজনে এক মানুষ থাকবেন না
"
স্বীকার করা দরকার, কলকাতায় মুসলিম মেয়েদের এই আন্দোলন স্বতস্ফূ্র্তভাবে শুরু হয়েছে। যেকোন স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনেরই কিছু ইতিবাচক দিক থাকে, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। আন্দোলনের মধ্যেও নানা ঘাতপ্রতিঘাত চলে। এই ঘাতপ্রতিঘাতের বিশ্লেষণ মুসলিম নেত্রীরা নিশ্চয়ই পরে করবেন। কিন্তু একজন নারীবাদী হিসেবে বাইরে থেকে দেখে এই আন্দোলনকে আমার নারী আন্দোলনের চরম সার্থকতা বলে মনে হয়েছে। সর্বস্তরের মুসলিম মহিলারা তাদের অন্যান্য পরিচিতির ব্যবধান ভুলে ধর্না মঞ্চগুলিতে যে জনজোয়ার তৈরী করছেন, তা স্বাধীনতা আন্দোলনের পর ভারতবর্ষ দেখেছে কিনা সন্দেহ। এদের মধ্যে অনেকের যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে, আবার অনেকের অক্ষরপরিচিতিও নেই। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা এদের এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে। অনেকেরই হয়তো একলা বাড়ির বাইরে রাত জাগার অভিজ্ঞতা প্রথম হল। এর ফলে এই মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনেও একটা বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা। যেদিন এই ধর্না সাঙ্গ হবে, সেদিন নিশ্চয়ই যে তারান্নুম প্রথমদিন ধর্না মঞ্চে এসেছিলেন আর যে তারান্নুম আন্দোলন শেষে বাড়ি ফিরবেন, দুজনে এক মানুষ থাকবেন না। আমাদের সকলেরই জীবনে তাই হয়েছে।
আন্দোলন মেয়েদের পথকে চেনায়, যে পথে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের ব্রাত্য করে রাখে পিতৃতন্ত্র। কিন্তু আমাদের যে পথ চলাতেই আনন্দ! মেয়ে হিসেবে, ইসলামধর্মাবলম্বী মেয়ে হিসেবে আজকের আন্দোলনের নেত্রীরা মূলধারার রাজনৈতিক পরিসরে নিজেদের আসন পাকা করবেন এবং দেশের জনগণকে পথ দেখাবেন, এই আশাই করি।
Link: https://ebongalap.org/muslim-women-in-movement-against-nrc