27-05-2024 07:54:38 am
Link: https://ebongalap.org/nrc-and-muslim-women-of-india
“অনেক ভাবলাম। শ্যাষে একটি কথা মনে হল, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সব কিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একেটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে; যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু, কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কীসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সেয়ামি গেলে আমি আর কি করবো? আমি আর আমার সেয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।
সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াবো আমি। আমি একা তা হোক সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি। একা।”
( আগুন পাখি – হাসান আজিজুল হক)
"
আপনাকে/তোমাকে/ তোকে একেবারে বাঙালির মতো দেখতে
"
স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময়ে আজিজুল হকের এই উপন্যাসের মতো অসংখ্য আগুনপাখির কথা আমরা খুব অল্প জানি অথবা জানিনা। আমাদের জানা জরুরী ছিল; তাহলে নতুন করে আবার সুপ্রিয়া খাতুন, চান্নু বেগম, নাসিমা, আসমা তারা, রৌশন দাদিদের পথে নেমে প্রবল শীতের দিনে তাঁবু পেতে মনে করাতে হতো না একই কথাগুলো। হুবহু এক কথা, যা বাঙালি মুসলমান বলতে বলতে ক্লান্ত ও অপমানিত দীর্ঘ সময় ধরে। পড়শিদের অবজ্ঞা জেনে বুঝে না জানার অহমিকার কারণে কতবার এই বাংলার মুসলমান মানুষগুলোকে শুনতে হয়েছে ‘আপনাকে/তোমাকে/ তোকে একেবারে বাঙালির মতো দেখতে’। আমরা কেউ রেগে গেছি, কেউ আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি, একটু হেসে কথাটা শুনে গেছি। তখনও এই দেশে অবজ্ঞা ,অনীহা ছিল, কিন্তু আজকের দিনের মতো অস্বীকৃতি ছিল না। তখনো পর্যন্ত ‘মুসলমানরা ভারতীয় নয়, এই দেশে তাঁদের কোন অধিকার নেই’—এই আখ্যানটা সংখ্যাগুরুর চেতনাতে সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়নি।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সব ওলট পালট হয়ে গেল। গত পাঁচ বছরে আমাদের পড়শি, আপনজন, বন্ধুরা হাটে-ঘাটে-মাঠে-বাসে-রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী নির্দ্বিধায় বলতে পারলেন ‘আমাদের দেশের মুসলমানগুলোকেও ওই রোহিঙ্গাগুলোর মতো খেদানো দরকার। খুব বাড় বেড়েছে এদের; আমাদের উন্নয়নের পথে এরাই যত বাধা; এতগুলো করে জন্ম দেয় এরা একদিন এরাই আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে’।
খুব পরিচিত চেনা মুখগুলো কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগলো।
দেশের সরকারের কারণে কি বদলে গেল এসব? অনেক অনেক ভেবেছি, মনে হয়েছে, না। দেশের সরকারে যেই থাকুন; বদলটা আগে এসেছে মানুষের মানবিকতাতে। যেদিন জুনেইদদের আখলাখদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার অসংখ্য ভিডিওগুলো, আমার দেশের অসংখ্য মানুষ নির্লিপ্ত ভাবে দেখেছেন ও কেউ কেউ উপভোগ করেছেন; এই ঘটনাগুলো ক্রমে যখন বাড়তে থেকেছে; রাস্তায় বেরোলে যখন মায়েরা জানেন তাঁদের সন্তানের নাম আসিফ, ইউসুফ, নাজিব হওয়ার কারণেই শুধুমাত্র তাঁদের সন্তানেরা ঘরে ফিরবেন না হয়তো; হয়তো তাঁদের সন্তানদের ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে অনেকে মিলে খুঁচিয়ে মারার দৃশ্য এই মাকে দেখতে হতে পারে—এই মায়েরা তখনো সহ্য করে ছিলেন। একথা ভেবে যে মানুষের মন ঠিক বদলাবে; এটা একটা খারাপ সময়, এ সময়টা বদলে যাবে। এখনও মায়েরা এমনটাই ভাবেন, তবে তা প্রখর শীতে; রাস্তার মোড়ে; অসংখ্য শহরের পথে; গঞ্জের পথে; গ্রামের পথে। তাঁরা নিজেদের পরম আদরের সন্তান আর নিজের জমিটুকু বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন।
আমরা শাহিনবাগ থেকে পার্কসার্কাস এই দুই জায়গার লড়াইয়ের কথা পড়ছি ও দেখছি। তবে আরও অসংখ্য জায়গাতে এমনভাবেই প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে উঠেছে; সেখানে মূলত বাঙালি মুসলমান মেয়েদের অংশগ্রহণের কথা আমরা কিছুটা আমাদের ‘এই সময়ের তথ্যায়ন’ ক’রে রেখে দিতে পারি।
"
ওরা আমাকে পাকিস্তানি বলল কেন মা?
খালা, দেশদ্রোহী মানে কি?
আমি তো আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি’।
"
টানা অনেকদিন পার্ক সার্কাসে ছিলাম; কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম জেলাগুলোতে আরও খারাপ অবস্থা। সামসুনদি’র মেয়ে, আমারও মেয়ে—আমার আর সামসুনদি’র কারোর কাছেই সেদিন কোন জবাব ছিল না—সাত বছরের কুহু যেদিন আমাদের প্রশ্ন করেছিল ‘তাহলে এই দেশটা কি আমাদের ছিল না? ওরা আমাকে পাকিস্তানি বলল কেন মা? খালা, দেশদ্রোহী মানে কি? আমি তো আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি’। ছোট্ট কুহুর এমন হাজারো প্রশ্নের কোন উত্তর আমার বা সামসুনদি’র কাছে নেই। আমরা কী করতে পারি পথে নেমে বুঝে নেওয়ার লড়াই ছাড়া? এই মুহূর্তে আর কী করা যায়?
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে যে মেয়েদের ধর্না বসেছিল তা ২৯ জানুয়ারি উঠে যায়। কারণ ওই সময়টা ছিল কৃষিপ্রধান ওই অঞ্চলে সর্ষে ওঠা ও ধান বোনার সময়। ওই সময়ে বাড়িতে যে কাজগুলো থাকে সেগুলো ফেলে প্রতিদিন আসা যেমন অসুবিধা হচ্ছিল, তেমন বহরমপুরে আসা যাওয়ার খরচা কম করে এক এক জনের পঞ্চাশ টাকা, সেটা চলত তাঁদের বিড়ি বাঁধার সঞ্চয়ে, গ্রাম থেকেই অধিকাংশ মেয়েরা আসতেন, সারা দিন রাত থাকতেন। নিজেরা অপোক্ত ভাবেই শ্লোগান দেওয়া শুরু করেছিলেন। প্রথম যেদিন যাই সুপ্রিয়া খাতুন দিদি বলেন ‘ওই গানটা করো’—বলে নিজেই গেয়েছিলেন—‘হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’। সেদিন হিন্দি ভাষার এই গানটা যেন তাঁদের গলা ও উচ্চারণে সম্পূর্ণ তাঁদের নিজস্ব হয়ে উঠেছিল। চান্নু বেগম তাঁর নিজস্ব বাংলা টানে একদিন টানা বলে চলেছিলেন ‘মেরে মরনে কে বাদ মেরে খুন সে ইনকিলাব লিখ দেনা / উসি খুন সে মেরি মাথা পে ভারত লিখ দেনা’—এটা কখন যেন ধর্নার মেয়েরা শিখে নিলেন, চান্নু বেগমের সাথে তাঁরাও সুর মেলালেন ‘ইনকিলাব লিখ দেনা’... ভারত লিখ দেনা’...
ওই ধর্নাতে কান্দি থেকে শ্রমজীবী মঞ্চের মহিলারা গান গাইতে এলেন। তাঁরা গাইলেন
“যত হামলা করো/সব সামলে নেবো/চ্যালেঞ্জ তোমায় যদি মারতে পারো/অনেক মেরেছ তবু মরিনি আজও”।
এই প্রতিরোধ মঞ্চটা কখনো কখনো যেন কী প্রবল শোষিত মানুষের লড়াই হয়ে উঠত। জেলাগুলোতে এই সংবিধান ও দেশ বাঁচানোর লড়াই লড়াই রূপ নিতো শ্রমজীবী শোষিত শ্রেণীর লড়াইয়ের। কোথাও কোন লাল পতাকা নেই; কাস্তে হাতুড়ি নেই; কিন্তু ধর্না মঞ্চে যখন ১৬ ঘণ্টা কাজ করা বিড়ি শ্রমিক মহিলারা শ্লোগান দিতেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ তখন এই লড়াইটা কতো কতো নিগড় ভাঙতে ভাঙতে পথ পেরোত।
"
আমার দেশেই আমার কবর হবে, মোদীকে বলে দিও
"
রৌশন বিবি, আশি বছরের এক বৃদ্ধা, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে কথা বলতে বলতে। প্রায় তাকে ধর্না মঞ্চে দিনভোর থাকতে দেখি। একদিন হাতটা শক্ত করে ধরে বলেন; “শোনো মোদীকে গিয়ে বল আমি আমার দেশ ছেড়ে যাবো না; উনারও (মৃত স্বামী) কবর আছে, উনার পাশেই আমার কবর হবে। আমার দেশেই আমার কবর হবে, মোদীকে বলে দিও”।
আসমাতারা দলবল গুছিয়ে ১০-১২ জন করে তারকপুর থেকে রোজ আসতেন ধর্নামঞ্চে। একদিন বলেন ‘দিদি আমার উনি বলেন; প্রত্যেক দিন যেতে হবে না; আমি বলেছি উনাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে তো আমরা আমাদের মাটি বাঁচানোর লড়াইটা করবো। প্রত্যেক দিন যাবো।
ইয়াসমিন বলেছিল ‘আমার উনি তো ওই দিদির দল করে; উনি বলে দিদি থাকতে কিছু হবে না। উনি দিদির মিছিলে যেতে বলতো; আমার কোন দলের পতাকা নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে না। এখানে কোন দলের পতাকা নেই। আমাদের সন্তানের জন্য আমরা লড়ছি, কোন দল তো লড়বে ভোটের জন্য! এই সময়ে মাঠের এতো কাজ সব ছেড়ে চলে আসি। মাঠ ঘাট কিছুই থাকবে না, এই লড়াইতো মাঠঘাটের জন্যও’।
"
এই সময়ে মাঠের এতো কাজ সব ছেড়ে চলে আসি।
মাঠ ঘাট কিছুই থাকবে না,
এই লড়াইতো মাঠঘাটের জন্যও’।
"
বহরমপুরের এই ধর্নামঞ্চ চলতে চলতে অবস্থান শুরু হয় পলাশীতেও। এখানে প্রথম কয়েকদিন হাজার হাজার লোকের সমাবেশ থাকলেও মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। সময়ের সাথে সাথে হয়তো এখানেও মহিলারাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে উঠে আসবেন।
বাঙালি মুসলমান নারীদের একটা অংশ যারা কখনো মিছিলে হাঁটেন নি; তাঁদের একটা অংশ আজ রাস্তায়। দেশের এই সময়টা যতটা খারাপ ততখানি ভালো কারণ এতদিন যে ভারতমাতার নামে বিদ্বেষকামী রাজনীতি বেড়ে চলেছিল, সেই রাজনীতির মুখোমুখি ‘ভারতমায়েরা’ মাতৃভূমির জন্য ফুঁসে উঠবেন ভাবতে পারেনি অনেকে। আমরা সময়ের চোখে চোখ রাখলে দেখতে পাবো আরও অসংখ্য মায়েদের নিজস্ব আখ্যান। অসংখ্য আগুন পাখি।
Link: https://ebongalap.org/nrc-and-muslim-women-of-india