11-02-2024 13:10:48 pm
Link: https://ebongalap.org/other-side-of-masculinity-conversation-with-soumik-nandy-majumdar
কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসেছে ছোট্ট মেম, বাবা-মায়ের সাথে৷ কুড়িয়ে পাওয়া পাথর আর উপহার পাওয়া বই ভুল করে ফেলে এসেছিল “সৌমিকের” বাড়িতে৷ টিপটিপে বৃষ্টিতে টোটোরিকশায় হেলমেট পরে সৌমিক হাজির পরদিন —ঘন্টাকয়েক পরেই মেমদের কলকাতা ফিরবার ট্রেন - “এই! ঠিক ভুলে এসেছিলি!” বলে সযত্নে মেমের বই আর পাথর বের হয় ঝোলা থেকে৷ মেয়ের মা বলে, “এই না হলে সৌমিক!” ‘সৌমিক’ বলে, “এই না হলে মা!” সত্যি তো, কতজনের কাছেই ‘মায়ের মত’ আমাদের সৌমিকদা৷ আমার ছোটবেলায় পাঁচ-সাত-দশ বছরের ছানাদের কাছে সৌমিকদাদা শুধু মজার মানুষ কাছের মানুষই ছিল না, অনেক মোলায়েম নিশ্চিন্তি লেগে আছে সৌমিকদার সঙ্গে সব স্মৃতিতে৷ এই যে সৌমিকদাকে ‘মায়ের মত’ বললাম, এখানে “মায়ের মত” কথাটার কোনও মানে নেই আলাদা ক’রে, তবু স্নেহ-যত্ন-মায়া-মমতা মেশানো একটা উপস্থিতি, সব দিকে যার খেয়াল – এমন হলেই আমাদের সমাজ তাকে “মায়ের মত”-ই বলে না?
বই পড়েন, রাঁধেন, হয়তো চুল-ও বাঁধেন, জোগাড় করেন খেলনা পুতুল, পরম যত্নে ছোটদের শেখান অরিগ্যামি—এমন নানান জিনিস মিলিয়েই সৌমিক নন্দী মজুমদার৷ আর সেই সৌমিকদার সাথেই ওর বাড়িতে কথা বলতে যাওয়া - ওর স্কুলের কথা, তারপর কলাভবন আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাসকুলিনিটি-র এপিঠ ওপিঠ উলটে পালটে দেখা সৌমিকদার সাথে। যে সৌমিকদাকে তথাকথিত ‘মাসকুলিনিটি’-র বারকোশে কখনই ভরা যায় নি৷
জীবনটা একেবারে সাদামাটা ছিল তা বলা যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও সেখানে ‘জেন্ডার রোল’-এর ধারণাটা ছিল যথেষ্ট ফ্লুইড। ছিলনা পুরুষালি-মেয়েলি প্রাত্যহিক কাজের ধ্যানধারণা৷ ইস্কুলটাও ছিল আর বাকি ইস্কুলের থেকে ভিন্ন গোছের৷
- “একবার বাংলা পরীক্ষা, ফাইনাল, কিন্তু আমি খুব পড়ে-টড়ে গেছি ইংলিশ” ।
বলছিল সৌমিকদা।
- তা ইস্কুল কি করল?
- “কি আবার! মাষ্টার মশাইরা শুনে বললেন বেশ তো, ইংলিশ তৈরী করে এসেছে যখন তাই পরীক্ষা দিক - কাল বাংলা দেবে৷ আসলে ক্লাস নাইন টেনের আগে তো বার্ষিক পরীক্ষা জিনিসটাই ছিল না তখন৷”
তো সৌমিকদার এমন ইস্কুলের পরেই বিশ্ববিদ্যালয় — শান্তিনিকেতনের কলাভবন৷ শুনেছি আগে একটা প্রচলিত কথা ছিল যে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা খুব ন্যাকা হয়৷ এই ন্যাকামি নাকি সংক্রামকও। তার ওপর আবার কলাভবনে প্রথাগত শিল্পশিক্ষার বাইরে প্রথম এক বছর সব ছাত্রছাত্রীদের সমানভাবে যেমন স্কাল্পচার শিখতে হয়, তেমনই শিখতে হয় তাঁত বা আলপনা, যা আপাত দৃষ্টিতে ‘মেয়েলি’ এবং প্রথাগত শিল্পশিক্ষায় অপাংক্তেয়৷ তবু এতকিছুর পরেও সরষের মধ্যেই ভূত থাকে। আর তথাকথিত ‘লিবারাল’ প্রতিষ্ঠানেও থাকে পুরুষতন্ত্রের কটাক্ষ। সেই প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র থেকে শিক্ষক হওয়ার টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা উঠে এল কথায় কথায়।
সৌমিকদার ঘরটির কথা বলে নিই আগেভাগে - যেদিকে চোখ যায়, স্তূপাকৃতি বই৷ বই, বই, আর বই—কিছু তার ভারিক্কি গোছের, কিছু আবার রং ঝলমলে, মলাট ভরে তার ছোটবেলার মনে-গাঁথা ছবি৷ বইয়ের পাহাড়ের পাশে সূর্যাস্তের মত ঘেরাটোপে সাঁঝের বাতি। কোথাও ঝুলন্ত পুতুল-পাখি - রয়েছে সবাই, উঁকিঝুঁকি দিয়ে৷ বইয়ের প্রসঙ্গে আসে আরো বই, চায়ের সাথে আসে বিস্কুট—আলোচনা তো নয়, সন্ধ্যার গল্পের বৈঠক৷ একদিকে রয়েছে ঘরের পর ঘর ভর্তি বই, তেমনই আবার আছে রান্নাঘরের খুঁটিনাটি, আছে পরিপাটি গৃহস্থালির দায়-দায়িত্ব৷ বাড়িতে মা, দিদি ও বোনের সাথে বড় হলেও ‘ছেলেদের কাজ’-‘মেয়েদের কাজ’ ইত্যাদি মেরুকরণের মধ্যে বড় না হওয়া সৌমিক নন্দী মজুমদার৷ ছোটবেলা থেকেই বাড়ির কাজে ছিল তার প্রবল উৎসাহ, ঘর মোছা থেকে সুযোগ বুঝে ফাঁকতালে রান্নাঘরে ঢুকে পড়া—অথচ এসব কখনই অদ্ভুত মনে হয়নি বাড়ির কারো৷
আর পাঁচটা বাড়ির মত ছিলও না এই বাড়ি—বাবা অফিস থেকে ফিরেই ইস্তিরি করতেন, রান্না করতেন, মা শুনতেন ও শোনাতেন ‘অনুরোধের আসর’ বা রেডিওতে ‘চাষীভাইদের বলছি’, মোট কথা মেয়েদের কাজ বা পুরুষের কাজ এরকম স্পষ্ট বিভাজন ছিল না বাড়ির পরিবেশে৷ কিন্তু ইস্কুলে? কলকাতা পাঠভবনের কোঁকড়াচুলো রোগা ছাত্রটি কখনই খেলাধুলোয় অত্যাশ্চর্য প্রতিভা দেখাতে পারেনি, কিন্তু খেলার উৎসাহ ছিল প্রবল। ঘেমে নেয়ে পাড়ার ফুটবলে অসংখ্য গোল খেয়ে সে বাড়ি ফিরত৷ ব্যাটিং করতে করতে একেবারে বিপক্ষের হাতেই তুলে দিত বল৷
- ‘বুলিড’ হতে হয়নি কখনো? যথেষ্ট পুরুষালী ছিলে না বলে?”
- না। আশ্চর্যভাবে কোন বিশেষ দাগ কাটেনি মনে এসব গোল খাওয়া, কারণ বাড়িতে ছিল বৈদ্যনাথের বড়ির মত ম্যাজিক ওষুধ - যার নাম হাতে লেখা পত্রিকা৷ বাবা-মায়েরও কোনও বিশেষ মাথাব্যাথা ছিলনা ছেলেকে পুরুষ_সিংহ করে তোলার। বরং মনা-র মা’র বহু সাবধানবাণী লঙ্ঘন করেই দিনের শেষে ক্লান্ত মা ছেলেটিকেই বলত – চাল ভিজিয়ে দাও৷ এক-আধদিন সুযোগ হত তরকারি রান্নারও৷ আর নিতান্ত খেলবার ইচ্ছে হলে ছোট বোনকে বোলার করে দিব্যি খেলা যেত—ব্যাটসম্যান, আর বোলার থাকত, ব্যস! আর দশটা হিজিবিজি আম্পায়ার ইত্যাদিকে ছোটানোর দরকারই বা কি?
- ইস্কুলও ছিল চিরাচরিত ধাঁচের থেকে আলাদা?
- নাঃ, আপাতভাবে খুব বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে যথেষ্ট ‘মাসকুলিন’ না হওয়ায়, এমনটা নয়৷ তবে তাচ্ছিল্য হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছে কখনো কখনো।
সেখানে আবার হাল ধরেছেন ভৌতবিজ্ঞানের শিক্ষক৷ স্নেহশীল গলায়, অথচ তীব্র শ্লেষে একটু একটু পুরুষ হয়ে ওঠা ছাত্রদের ব্যঙ্গ করে শুনিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের জীবনী। বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে উঠতে ঈশ্বরচন্দ্রের একটা সুন্দর সহনশীল মনই যথেষ্ট ছিল—বাসের পেছনে ঝোলা, কনুইয়ের গুঁতোগুঁতি বা বিরাট ছাতি আর মাসলের প্রয়োজন হয়নি৷ বয়ঃসন্ধির সময় প্রথম বন্ধুরা আসে বাড়িতে – গ্রুপ স্টাডি-র জন্য৷ আর তখনই কথায় বা হাবেভাবে কেউ কেউ প্রকাশ করে ফেলেছে যে গৃহকর্মে আপাত নিস্পৃহ মা, আর রান্না-বান্না, শিশুপালনে আনন্দ খোঁজা বাবা তারা আগে সেরকম দেখেনি৷ সেই প্রথম একটা সুস্পষ্ট বিচ্ছেদ হয়ে যায় ‘স্বাভাবিক’ আর ‘অস্বাভাবিক’-এর৷
জাম্প কাট ক’রে চলে আসি শিক্ষাদীক্ষার আরেক পর্বে; কলাভবনে পড়া ও পড়ানোয়৷ আপাত দৃষ্টিতে চারুকলা, সূচিকর্ম বা তাঁতের টান—এসব তো মহিলা মহলেরই জিম্মেওয়ারি৷ কলাভবনের মত প্রতিষ্ঠান কি জেন্ডার-বিভাজন বঞ্চিত? ছেলেরাও যে এখানে বয়নশিল্প শেখে!
তবু, একটা অলিখিত নিয়মবিধি ছিলই। মেয়েরা খুব একটা স্কাল্পচার বা ভারি কাজ করতে হবে এমন বিষয় নিতে ‘এনকারেজড’ হত না৷ অথচ সৌমিকদাই মনে করিয়ে দিল, যে গ্রাফিক ডিপার্টমেণ্ট বল বা লিথোগ্রাফি প্রেস, সেসব চালানোর ক্ষমতা তার নিজেরই ছিল না—বরং মঞ্জরীদি-শুভাদিরা অনায়াসে প্রিন্ট নিয়ে নিত৷ অথচ, এই কলাভবনেই বহুদিন কিন্তু ছিলেন না কোনও মহিলা শিক্ষিকা৷ হয়ত বা বিষয় নির্বাচনেও ছিল কোনও প্রচ্ছন্ন জেন্ডার বিভাজন৷
- “এখন কিন্তু ঠিক সেরকম না —তাঁত বোনা বা sculpture সমস্ত কিছুতেই ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সমান সমান৷”
- শিক্ষাপ্রণালীরও কিছু তফাৎ ঘটেছে নিশ্চয়ই—
- হ্যাঁ, কারণ আগে স্কাল্পচার মানেই ব্রোঞ্জ কাস্টিং, পাথর, চুন-সুড়কি৷ কিন্তু এখন সফট স্কাল্পচার- এর ধারণা এসেছে—তুলো, কাপড় এমন কি কাগজ দিয়েও তো বানানো হচ্ছে।
শিল্পের আলোচনায় ‘মেটিরিয়াল’-এর গুরুত্ব আমরা অনেক সময়েই ভুলে যাই, ভুলে যাই তার সাথে জেন্ডার-এর ওতপ্রত যোগাযোগ—যা আরো একবার মনে করিয়ে দেয় সৌমিকদাদা৷ আবার অন্যদিকে এটাও মনে করিয়ে দেয়, যে পুরুষতন্ত্র কত ছোট ছোট সহজ জিনিসে লুকিয়ে থাকে৷ প্রাতঃস্মরণীয় জন বার্জার তো বলেই গেছেন যে দেখার দৃষ্টি একটি রাজনৈতিক গল্প—সেই ধারণার প্রেক্ষিতেই যেন উঠে আসে ‘মডেল স্টাডি’-র কথা৷ সৌমিকদাদা বলে, তার বহু বন্ধু-বান্ধব ছাত্রাবস্থায় ‘ন্যুড স্টাডি’ করানোর বিরোধিতা করেছিল; তাদেরই সহপাঠীরা আবার বুঝিয়েছিল যে এত ভাবনার কিছু নেই –
- “যে খেলিদি ন্যুড মডেল হতেন, তাকে স্টাডি-র সময় একটা অবজেক্ট হিসাবে দেখলেই হবে! যতক্ষণ আমরা শিল্পী, খেলিদি একটা অবজেক্ট মাত্র৷ ন্যুড মডেল তাই ‘স্টিল লাইফ’-এর মতই। তারপর কিন্তু সেই খেলিদি-ই শাড়ী পরে এসে ক্যান্টিনে চা খাবে আমাদের সাথে, বলবে তার ছোট মেয়েটির গল্প।”
শিল্পশিক্ষার সামনে মানুষ বস্তু হয়ে যায় হয়ত এমনি করেই৷ শিক্ষাপদ্ধতির আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে আসে শিল্পীর সংজ্ঞা নিয়ে বলতে গিয়ে— ছাত্র-ছাত্রীরা না হয় সংখ্যায় সমান, কিন্তু গুণমানে?
-“জানিস, একবার মনে আছে, কথা উঠেছিল ছাত্রীদের আঁকা নিয়ে৷ একটি মেয়ে খুব হাল্কা রঙের স্ট্রোকে এঁকেছিল তার হস্টেলের ঘর, মশারি, চটি৷ যথেষ্ট ‘আউটডোর স্টাডি’ হয়নি বলে মাষ্টারমশাইরা কম নম্বর দিয়েছিলেন৷”
অথচ, আউটডোর স্টাডি-র ব্যবহারিক অসুবিধা, মেয়েদের ক্ষেত্রে, তাঁরা বুঝতে চাননি৷ সত্যি তো, রাতে-দুপুরে একলা সাইকেলে, বা বন্ধুদের সাথেও সকলে সমানভাবে বেরোতে পারে না৷ অথচ নম্বর দেওয়ার স্কেলটি যেন কেবল ছাত্রদের কথা ভেবেই তৈরি, তাদের নিরিখেই ঐ মাপকাঠি মেনে নিতে হবে মেয়েদের৷ এমনকি সেই নিরিখেই মেপে নেওয়া হয় ছেলেদেরও - তারা যথেষ্ট পুরুষালি কি না — যেমন মাপা হয়েছিল সৌমিকদাকেই৷ বড় বয়স পর্যন্ত ‘বিশেষ বান্ধবী’ না হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানেই আড়ে-ঢাড়ে বোঝার চেষ্টা হয়েছিল তার সেক্সুয়ালিটি-র ধরণটা কি৷ হস্টেলে প্রাত্যহিক গালগল্পে ঢুকে পড়েছিল প্রয়োজনীয় ‘মাসকুলিন’ প্রশ্নরা – মাস্টারবেশন কে করে, কার লিঙ্গের মাপ কী রকম ইত্যাদি।
- “হয়তো সহজ ভাবেই জিজ্ঞেস করেছে এসব,... কিন্তু, সেটাই যে ভয়ানক!”
সৌমিকদাদার কথা শুনতে শুনতে এডওয়ার্ড গোরে-র কথা মনে পড়ে গেল৷ একাধিক ইণ্টারভিউতে সেক্সুয়াল ওরিয়েণ্টেশন নিয়ে প্রশ্ন শুনতে শুনতে ক্লান্ত গোরে একবার বলেছিলেন ‘আই এম টেরিবলি আন্ডারসেক্সড’। আসলে, কত সহজেই আমরা ভেবে নিই যে অন্যের সেক্সুয়ালিটি মেপে নেওয়ার ষোল আনা অধিকার আমাদের আছে। আর তাই, কলাভবনের মত আপাত দৃষ্টিতে খোলামেলা এক প্রতিষ্ঠান, যেখানে মেয়েরাও লিথোগ্রাফের প্রেস ঘোরায়, ছেলেরা সিল্কের শাড়িতে বাটিকের পদ্মলতা আঁকে, সেখানেও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েই যায় জেন্ডার ঘিরে ক্ষমতায়ন৷
Link: https://ebongalap.org/other-side-of-masculinity-conversation-with-soumik-nandy-majumdar