08-03-2024 15:54:42 pm
Link: https://ebongalap.org/parabashe-nari-ea-series-by-shabnam-surita
সেই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাড়ি ছেড়ে ইউরোপে থাকি। আগে ছিল ডেনমার্ক, বর্তমানে জার্মানি। গত আড়াই বছরে আর কিছু না হোক, নিত্যনতুন ভাষায় নানাবিধ ফর্ম ফিলাপ করতে আমি বেশ পটু হয়ে গিয়েছি। আগে ডেনমার্কে থাকতে ডেনিশ ভাষা না জানায় সাথে করে এক বন্ধুকে নিয়ে যেতাম ধরে বেঁধে। ও দোভাষীর কাজ করত। ডেনমার্কে তাও অত চাপ হত না, সারা দেশেই সবাই ইংরেজি বোঝেন, বলেন। আমি যে শহরে থাকতাম, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বলে আরোই কোন সমস্যা হত না। ঝামেলাটা বাধল জার্মানি এসে।
জার্মান ভাষাটা প্রথম প্রথম অল্প অল্প বুঝতে পারলেও, বলার সময় বেশ হোঁচট খেতাম। কিন্ত আস্তে আস্তে ভাষাটাকে আমায় রপ্ত করতেই হলো। ডেনমার্কের মত এই দেশটা একদমই নয়। জার্মান না বলা আর ইংরেজি বলার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক আভাস থাকে এখানে সব সময়।
জার্মানিতে স্কুলে-কলেজে-আপিসে স্বাভাবিকভাবেই প্রধান ভাষা জার্মান। ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসী, স্প্যানিশ, তুর্কিশ, আরবি শেখানো হয় ইস্কুলে একটু বড় হবার পর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। ইংরেজিতে তাই জার্মানরা (অন্তত একটু ছোট শহরে বড় হওয়া জার্মানরা) একটু কাঁচাই। এখানে একটা মজার গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মিলে ঠিক করল একটা জার্নাল বের করবে, ইংরেজি ভাষায়। কমিটি গঠন হলো তার জন্য। কিন্ত সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করতে গিয়ে দেখা গেল গোটা কমিটিতে ‘নেটিভ লেভেল’ (অর্থাৎ, মাতৃভাষার মান) ইংরেজি জানা ব্যক্তি ভারতীয় বাদামী চামড়ার এই অধম। উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে জন্মানো আমার ভেতর সেদিন গর্ব হয়েছিল না লজ্জা, তা নিয়ে আমার এখনও সংশয়ের শেষ নেই। যাই হোক, মূল কথায় ফিরে যাই।
জার্মানরা ইংরেজিতে দুর্বল বলে কিনা জানি না, তবে জার্মানিতে একটা অন্যরকমের ভাষাভিত্তিক রাজনীতি আছে, তা টের পাই। যেমন কিছুদিন আগে ট্রেনে কাজে যাচ্ছি। আমার পড়শি আরেকটি ভারতীয় মেয়ের সাথে গল্প করছি। হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে কথা হচ্ছে। হঠাৎ সামনে বসা একটি ছেলে তার বান্ধবীকে জার্মান ভাষায় বলে উঠল, “এরা যে কেন এদেশে আসে! নিজেদের ভাষা না ছাড়ুক, জার্মান শিখতে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না। ইন্ডিয়ানরা আইটি সেক্টরে ভালো বলে, ইংরেজি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। আমাদের ভাষা চায় না।” আমি আর আমার সেই বান্ধবী দুজনেই মোটামুটি জার্মান জানি। স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম সব কথা। উত্তর দিলামও সেই ছেলেটিকে। কী বললাম তাতে যাচ্ছি না কারণ আমরা কিছু বলার আগেই ট্রেনের কামরার অন্য যাত্রীরা তাদের রীতিমত ধাক্কা দিয়ে পরের স্টেশনে নামিয়ে দিল বর্ণবাদী মন্তব্য করায়। জার্মানদের এই স্পিরিটটা আমায় বড্ড অনুপ্রাণিত করে। সারা দেশজুড়ে যখন অতিডানপন্থী দল, আ এফ ডে (Alternative for Germany) আস্তে আস্তে তার বিষফণা তুলছে, তখন সুপরিকল্পিতভাবে নাগরিকেরা তার বিরোধ করছেন, রাস্তায় নামছেন, সর্বত্র তুলছেন আওয়াজ।
কিন্ত আমার শুধু মনে পড়ে যায় ৮০০০ কিলোমিটার দূরে ফেলে আসা আমার দেশটাকে। যাকে আমার মতই, আরো অনেকে ভালোবাসেন। যারা মনেপ্রাণে চান, এদেশের মাটিতেও গড়ে উঠুক একটি চিন্তাশীল মানবসমাজ। কিন্ত দেশের মাটিতে ভালোবাসা যে বড্ড কঠিন কাজ! তার চেয়ে হিংসা, ঘৃণা বরং এ মাটিতে অনেক বেশি স্বাভাবিক। কিছুদিন আগে ট্রেনে শিলচর থেকে ডিমাপুর যাচ্ছি। সাধারণ কামরায় উঠেছি, রিজার্ভেশন নেই বলে। নানা রকমের মানুষ আমার চারপাশে, তাদের বিচিত্র সমস্ত ধ্যান-ধারণাসহ ট্রেনে চেপেছেন। আমার সামনে বসা একটি ভদ্রলোক অকপট সাম্প্রদায়িকতায় লিপ্ত। তার উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে প্রতি মূহুর্তে ফুটে উঠছে তার ভেতরের বাস করা ঘৃণার পাহাড়। আমি কাঁচুমাচু মুখে সামান্য প্রতিরোধ করতে গেলাম। ফলত, গোটা ট্রেনের কামরা লেগে পড়ল আমায় ভুল প্রমাণ করতে। অল্পবয়েসী মেয়ে হয়ে কীভাবে সাহস হয় আমার দেশের, দশের হয়ে কথা বলার, কীভাবে আমি ‘না জেনে, না বুঝে, চিরকালের অসভ্য’ মুসলমানেদের ভারতবর্ষে থাকার অধিকারের কথা বলি- এসব তারা ভেবেই পায় না। তাদের চোখে আমি দেশদ্রোহী। বাংলায় কথা বলা আমি তাদের চোখে বাংলাদেশী, বিদেশি। সত্যি বলছি, মাঝে মাঝে আর রাগ হয় না। শুধু কান্না পায়।
যাই হোক, হাতে কিছুদিন ছুটি থাকলেই আমি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আর ইউরোপে থাকার মস্ত বড় সুবিধা হলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে ভিসা লাগে না এবং দেশগুলি একদম কাছাকাছি। সুতরাং আমায় আর পায় কে! দেশে দেশে, এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়াই। দিনরাত কাটাই অচেনা মানুষ, ভাষার মাঝে। বিভিন্ন ভাষায় ভালোবাসার পাঠ, ঘৃণার শব্দাবলী শিখি। দেখি, কীভাবে বিশ্বজোড়া এক অদ্ভুত ঘৃণার মেঘ আমাদের সবাইকে ঘিরে ধরছে প্রতিদিন। আমার দেশের মাটিতে গোমাংসের জন্য হোক বা জার্মানিতে ভিনধর্মী পোশাকের কারণে—মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার কোন অন্ত নেই কোথাও। আশার কথা এটাই, যে আমরা কয়েকজন এখনও একটা সীমানাহীন দুনিয়ার কথা ভাবি, মনেপ্রাণে চাই ভালোবাসতে কোনদিন কোনো ভিসা না লাগুক। আমার মত আরো যত শিকড়-উপড়ানো সন্তানেরা আছে, তাদের সমবেত অঙ্গীকার হোক ‘ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়’[1] গড়ার। যাতে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে উঠে আসা সমস্ত বিভেদমনা আঙুলের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার আলিঙ্গন ভীরু না হয়ে পড়ে কখনই।
[1] ‘ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দবন্ধটি কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী থেকে ধার করা।
Link: https://ebongalap.org/parabashe-nari-ea-series-by-shabnam-surita