22-06-2024 11:35:12 am
Link: https://ebongalap.org/park-circus-sit-in-kolkata-on-nrc
গল্পের নাম পার্ক সার্কাস, লড়াই-এর গল্প। এই যে আশমত, রহিমা, রেশমা, আফসানা, নীলোফার, আয়েশা... প্রত্যেকে নিজের নিজের গল্প নিয়ে এসেছেন| প্রত্যেকে পাশাপাশি গলা ছেড়ে আজাদী গাইছেন। মুড়ি ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন বিরতিতে। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে, মাইকে বক্তৃতা, তারই মাঝে নামাজের সময় হয়ে এলে সন্ধেবেলা নামাজ পড়তে বসলেন আয়েশা খাতুন। আবালবৃদ্ধবনিতা—কেউ স্কুল সেরে মায়ের সঙ্গে এসে বসেছে, কেউ কোলের ছেলের ক্যাঁ-ক্যাঁ সামলাতে সামলাতে বিস্কুট চিবোচ্ছেন। ওঁরা বলছেন শাহীন বাগের দাদীকে দেখে অনুপ্রাণিত ওঁরা, তাঁর আবার একখানা নামও দিয়েছেন, দাবাং দাদী! জবুথবু হয়ে ময়দানের মাঝের উঠোনে ঢালাও কার্পেটে বসে আছি আমরা, কোথায় বিভেদ! সকলেই এক কম্বলে বসে স্লোগান দিচ্ছি। এই যে ভারতবাসীর মানসিকতায় সুচারুভাবে বিভেদ বুনে দেওয়ার প্রোজেক্ট, তা সত্তর বছরের—আমরা প্রায় সকলেই সেটা জানি এখন। কিন্তু এই সাহস নতুন। এই লড়াই নতুন। এই লড়াই-এর পথ দেখাচ্ছেন বোরখায় ঢাকা এবং বোরখা ছুঁড়ে ফেলা সমস্ত মুসলিম মেয়েরা। কারণ প্রশ্নটা বোরখার নয়, প্রশ্নটা সাহসের। প্রশ্নটা বোরখা পরে হিন্দু-প্রধান রাস্তায় হেঁটে আসার আর বোরখা খুলে ফেলে ময়দানে গজল্লা দেওয়ার। সেই সাহসকে সেলাম না জানাবে এমন মুরোদ আছে কলকাতার?
তাই লাল সেলাম জানাচ্ছে জনতা। তাই হাজার মিছিল, অবরোধ এবং পথসভার পর, কয়েকবার পুলিশের হাতে বিভিন্ন স্তরে মার খাওয়ার পরও, অবস্থানে এসে জুটছে গোটা কলকাতা। বিগত দুই হপ্তা এই অবস্থানে মুসলিম মেয়েদের নেতৃত্বে স্লোগান দিয়েছি আমরা, তাঁদের বক্তব্য শুনেছি। কেউ গৃহবধূ কেউ শিক্ষিকা কেউ পরিচারিকা কেউ বেসরকারি সংস্থার কর্মী ও নেত্রী কেউ সমাজকর্মী। প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিসরে বুঝে ফেলেছেন রাষ্ট্রের কুচক্র। কেউ বলছে “মোদী শাহ না গেলে আমরা হটবো না, বিজেপিই চাই না” তো কেউ বলছে “মোদী ব্যাটা বদমাশ, চা বানাতে বানাতে সব জেনে গেছে”!
মুসলিম মেয়েদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া পার্ক সার্কাসের এই অবস্থানের সাংগঠনিক ভূমিকায় রয়েছে ‘অজ্জুমর’। মুসলিম মহিলাদের একজোট করার কাজ বেশ কিছুদিন ধরে চালাচ্ছে এই সংস্থা। যে প্রত্যন্ত কমিউনিটিগুলোতে মহিলাদের সুযোগ-সুবিধে খুব কম এবং সামাজিক সমস্যা অনেক, তাদের নিয়েই কাজ করে অজ্জুমর। মেয়েদের একজোট করার কাজ, নিজেদের ঘরের লড়াই, পিতৃতন্ত্রের সাথে লড়াই চলবে ঠিকই, কিন্তু এখন ওদের লক্ষ্যস্থির—এখন ওরা পিতৃতন্ত্রের রক্ষক রাষ্ট্রকে তাক করেছেন। যে রাষ্ট্র তাঁদের প্রতারণা করেছে, তাঁদের দেওয়া ভোটকে অপমান করেছে, যে রাষ্ট্র আজ তাঁদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চাইছে, তাঁদের প্রতি সবরকম দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, সেই রাষ্ট্রই এখন এই একজোট নারী-কণ্ঠের নিশানা। তাঁরা গর্জে উঠছেন রাষ্ট্রকে তাক করে, তাতে পুরুষে যোগ দেয় দেবে, কিন্তু মাইক কেড়ে নিতে দেওয়া হবে না, ক্ষমতায় আছে পার্ক সার্কাসের মেয়েরাই। শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরে আছেন, সেলাম তাঁদের।
অজ্জুমর শব্দটির অর্থ জিজ্ঞেস করতেই হেসে উঠলেন আশমত আপা, চোখে যেন এক ঝিলিক দেওয়া আনন্দ, বললেন—ইক্যুয়ালিটি, ‘সমতা’। আমিও আনন্দে হেসে ফেললাম। একটা সাঙ্কেতিক আদান প্রদান হয়ে গেলো আমাদের মধ্যে, যার আড়ালে হাজার বছরের বিপ্লব, মেয়েদের সমতার লড়াই, সমানাধিকারের যুদ্ধ। সত্যিই তো, যুগে যুগে সমস্ত বিপ্লব শুধু এই একটাই দাবী নিয়েই, তাই না? আর কি হতে পারে আমাদের লড়াই সমতার লড়াই ছাড়া? সমান অধিকারের স্বপ্ন দেখার সাহস ছাড়া আর কি বা আছে আমাদের!
পার্ক সার্কাস ময়দানে অবস্থানের প্রথম দিন ৭ই জানুয়ারি-র সন্ধ্যায় এই লড়াকু মেয়েদের টুকরো টুকরো জবানবন্দি নিয়েই নিচের ভিডিওটি।
Link: https://ebongalap.org/park-circus-sit-in-kolkata-on-nrc