04-06-2024 12:33:38 pm
Link: https://ebongalap.org/school-drop-out-during-lockdown
রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান চলছিল স্কুলের বড় হল ঘরে। হঠাৎ ছন্দপতন। ঝড়ের মতো ছুটে এসে স্কুলেরই এক ছাত্রী খবর দিল — ‘বিজলী সুইসাইড করেছে’। সেটা ২০০৮ সালের কথা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার পছন্দের পাত্রকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হয়েছিল বিজলীকে। এক বছরের মাথায় একটি সন্তান হয়। কিন্তু সন্তানের বয়স যখন তিন মাস, তখনই একদিন দুপুরবেলায়, নিভৃতে, গলায়… । পুলিশের খাতায় আত্মহত্যার কারণ হিসাবে লেখা হয়েছিল — ‘গভীর অবসাদ’।
শিক্ষক হিসাবে আমার চাকরির বয়স তখন সবে মাত্র দুই বছর পেরিয়েছে। এরই মধ্যে বিজলীর মতো আরও অনেক ছেলে-মেয়েকে দেখেছি, যারা বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমের পাকেচক্রে পড়ে হারিয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই চুপ করে বসে থাকা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। সবাই মিলে ঠিক করলাম, লড়তে হবে। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে ক্লাসে ক্লাসে লাগাতার প্রচার। গ্রামে মাসে একবার করে শোভাযাত্রা। স্কুলের দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার। সঙ্গে চলল দু’মাস বা তিন মাস পর পর গার্জিয়ান মিটিং করে নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে পাঠদান। দলে এসে জুটল হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদ ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।
বছর দুই পেরোতেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাতে লাগল। ২০১২ সাল নাগাদ সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেই নিজের বিয়ে রুখে দিল। পরের বছর নবম শ্রেণির আর একজন ছাত্রীও বেঁকে বসল, মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে কিছুতেই বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি হল না সে। স্থানীয় মোড়ল-মাতব্বর, আগে যাদের নাবালিকা বিয়েতে ঘটা করে নেমন্তন্ন খেতে দেখেছি, অবস্থা বুঝে তারাও পিছু হঠতে শুরু করলেন। স্কুলের অগোচরে গোপনে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, এমন খবর পেলেই দল বেঁধে হাজির হতেন শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর দল। কখনও প্রশাসনের সাহায্য চেয়ে চিঠি-চাপাটি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল — জোর করে নাবালিকা বিয়ে দেওয়ার ঘটনা নেমে আসে প্রায় শূণ্যের ঘরে।
তবে স্কুলের গণ্ডি ডিঙানোর আগেই, পরিবারের অমতে, স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ার ঘটনাকে পুরোপুরি থামানো যায়নি। বহু ক্ষেত্রে দেখেছি, যারা নাবালিকা অবস্থায় এরকম ভুলের ফাঁদে পা দেয়, অনেকেই ‘অল্প বয়সে পেকে গেছে’ বলে দায় এড়িয়ে যায়। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই পরিষ্কার হবে, দুটি সমস্যার শিকড় একই জায়গায় — সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রান্তিক অবস্থান। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে, স্কুলের চেষ্টায় এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে বন্ধ হল, খবরের কাগজে ছবি ওঠে, ‘কন্যাশ্রী’ পুরষ্কার তুলে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু, মেয়েটির বাবা ছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত, প্রশাসন সাহায্যের আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি। ফলে যে মেয়ে একদিন বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল, পরে সেটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিল।
প্রশাসনের একাংশের অভিজাতসুলভ চিন্তাভাবনা ও দায়সারা মনোভাব পরিলক্ষিত হয় স্কুলছুটদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের ক্ষেত্রেও। বিদ্যালয় ছুটের একটি প্রাধান কারণ অবশ্যই পরিবারের আর্থিক দুর্দশা। বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে উদ্যোগী হতে স্থানীয় বিডিও সাহেবের কাছে দরবার করি। বিডিও সাহেব বিষয়টিকে শিশু আধিকারিকের টেবিলে ঠেলে দেন। সব শুনে আধিকারিক মশাই প্রতিশ্রুতি দিলেন, তাঁরা মালঞ্চ গ্রামে একটা সার্ভে করে দেখবেন, কতজন শিশু শ্রমিক রয়েছে, এবং সেই মতো ব্যবস্থা নেবেন। ওই পরিবারগুলিকে আর্থিক সাহায্য করার প্রস্তাবের সঙ্গেও সহমত পোষণ করেন তিনি। কিন্তু বছর চারেক ঘোরাঘুরি করার পরে বুঝতে পারলাম, সমীক্ষা তো দূর, প্রশাসনের চিন্তা-ভাবনায় এই মানুষগুলির কোথাও কোনও জায়গা নেই।
স্কুলের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শিক্ষাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নাবালিকা বিবাহ ও স্কুলছুটের বিরুদ্ধে লড়াই তো বটেই, ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য (শারীরিক ও মানসিক) সম্পর্কে যত্নবান হওয়া, প্রতিনিয়ত তাদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখাও বিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ। স্কুল খোলা থাকলে এধরনের কাজে গতি আসে, সকলে মিলে পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভব। তাছাড়া স্কুল খোলা থাকা মানে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক তথা বিদ্যালয়ের একটা সামগ্রিক নজরদারি ব্যবস্থার মধ্যে থাকে। কিন্তু অতিমারী এই ব্যবস্থাটাকে তছনছ করে দিয়েছে। সাময়িক হলেও আলগা হয়ে পড়েছে ছাত্র-শিক্ষক-বিদ্যালয়ের চিরায়ত সম্পর্ক। যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনায় স্বচ্ছল, অনলাইন(পড়ুন হোয়াটসঅ্যাপ) ক্লাসের দৌলতে কিছুটা হলেও যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু যাদের সে সামর্থ্য নেই? ক্রমশই তারা চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। ভয়টা এখানেই।
এই সেদিন খবর পেলাম লকডাউনের মধ্যে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র বাজারে লেবু বিক্রি করতে বসেছে। এক ছাত্রী ফোন করে জানাল, ‘স্যার শম্পাদের খুব প্রোবলেম, বোধহয় ওর বিয়ে হয়ে যাবে’। ফোন বন্ধ। বাধ্য হয়ে দ্বারস্থ হই ‘হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদ’ ও ‘সায়েন্স ফর অল’ নামক স্থানীয় দুটি সংগঠনের সঙ্গে। পরিবেশ দিবস পালন করা থেকে স্বাস্থ্য শিবির, বিজ্ঞান দিবস পালন থেকে কুংস্কারবিরোধী প্রচার, স্কুলের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গী এই দুটি শিক্ষাদরদী প্রতিষ্ঠান। অতিমারীর দিনেও তারাই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। তাঁরাও জানিয়েছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে স্কুলছুট, নাবালিকা বিবাহ, নাবালিকা পাচারের ঘটনাও মহামারীর আকার নেবে।
কন্যাশ্রী আমাদের রাজ্যের বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে কতটা সহায়ক হয়েছে, তা গবেষণার বিষয়। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারের আর্থিক প্রণোদনা সব সময়ই মানুষের মধ্যে ইতিবাচক উৎসাহ সৃষ্টি করে। কন্যাশ্রীও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কোভিডের কারণে দেশের প্রান্তিক মানুষ যে দুরবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, তাতে বহু অভিভাবক নিজেদের রোজগার বা ক্ষুণ্ণিবৃত্তির উপায় নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন। সন্তানদের বাড়িতে বসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তাদের কাছে মনে হতে পারে বিলাসিতা। তাই দ্রুত সরকারের উচিত একটি সার্বিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া, যা শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখতে উৎসাহ দেবে, আবার দরিদ্র পরিবারগুলির কিছু স্থায়ী রোজগারেরও পথ দেখাবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যায়-বরাদ্দ বাড়ানো বা প্রান্তিক মানুষদের প্রতি কর্তব্য পালনে আমাদের দেশের সরকারগুলির (রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার) অনীহা বরাবরের। নীতিনির্ধারকদের একাংশও বেসরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো সামনে রেখেই সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে তৎপর। অথচ বাস্তবটা হল সাইকেল গ্যারেজ, হোটেল, রেস্টোরেন্ট, চায়ের দোকান বা রোজগারের আশায় ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া ছেলের দল কোনও বেসরকারি স্কুলের নয়, সরকার-পোষিত স্কুলেরই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া শিশু বা কিশোর। একই কথা প্রযোজ্য বালিকাবধূদের ক্ষেত্রেও। এই মুহূর্তে স্কুল খোলা উচিত কিনা, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে লকডাউনের সময়সীমা আরও বাড়লে, এবং সরকারও যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে, আরও বড় বিপর্যয় দেখতে হবে আমাদের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Link: https://ebongalap.org/school-drop-out-during-lockdown