08-03-2024 13:20:13 pm
Link: https://ebongalap.org/school-syllabus-gender-discrimination
বর্তমান সমাজে ক্রমবর্ধমান যৌন নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য, মেয়েদের উপরে নানান বিধিনিষেধ ও তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা একধরনের যৌন মৌলবাদের ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে। কিন্তু এই মৌলবাদী চেতনার বীজ কোথায়? ধর্ষণকে অবাধ্য মহিলাদের শাস্তি বিধানের কার্যকরী ব্যবস্থা মনে করা, ঋতুমতী মহিলাদের অপবিত্র মনে করা বা যেকোনো মেয়েকেই পুরুষের যৌন চাহিদা মেটানো ও পুরুষ সন্তান জন্ম দেবার কল মনে করা – এই ধারণাগুলোর পেছনে কাজ করে দীর্ঘ পারিপার্শ্বিক এবং শিক্ষাগত প্রভাব। তাই, শিক্ষার প্রথম স্তর থেকেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব নির্মাণে ও সংরক্ষণে স্কুলের পাঠ্যক্রম, পঠনপাঠন ও চর্চার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার চর্চা ও পঠনপাঠন স্কুলস্তরে অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় কিছুটা হলেও অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। প্রাথমিক ভাবে শুনতে অবাক লাগলেও, এটা বাস্তব যে এই তথাকথিত আধুনিক ‘ইংরেজি শিক্ষা’ স্কুলস্তর থেকেই সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য সংরক্ষণে ধারাবাহিকভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারী শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি কেবল মাত্র একটি ‘দক্ষতা বিষয়’ বা ‘স্কিল সাবজেক্ট’ নয়। একে একটি ‘কন্টেন্ট সাবজেক্ট’-ও ধরা হয়ে থাকে। একদিকে, অন্যান্য কন্টেন্ট সাবজেক্ট-এর তুলনায় ইংরেজি পাঠ্য বই এবং তার অন্তর্গত পাঠ্য বিষয়গুলির দৈর্ঘ্য এবং গভীরতা বেশ কম। অপরদিকে, সপ্তাহে ছ’ দিনই স্কুলগুলিতে এক বা একাধিক পিরিয়ড ইংরেজির জন্য বরাদ্দ করা হয়। পঠনপাঠনের ব্যবস্থাটা এমনই যে শিক্ষার্থীরা এই প্রাত্যহিক তালিমে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করার বদলে পাঠ্যের বিষয়বস্তু নিজেদের চিন্তাভাবনায় গেঁথে ফেলে, যা পরবর্তীকালে তাদের জীবনদর্শনকে প্রভাবিত করে। আমাদের চিন্তাভাবনা, সমাজ ও জীবনযাপনে খুব ধীরে হলেও বদল আসতে পারত যদি স্কুলস্তর থেকেই পাঠ্যক্রম বা পাঠ্য বিষয়গুলি একটু বদল ক’রে দেখার কথা ভাবা হত। তিন দশকের উপর স্থায়ী বাম জমানায় হাই স্কুলের ইংরেজি পাঠ্য পুস্তকগুলি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে পাঠ্যগুলি দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে গেছে। ইংরেজি পড়ানো শুরুর বয়স কী হওয়া উচিত তাই নিয়ে অন্ততপক্ষে চার বার সরকারী সিদ্ধান্ত বদলেছে, অথচ, একই পাঠ্য বছরের পর বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হচ্ছে। আমি এখানে বিগত বামফ্রণ্ট সরকারের আমলে এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারের জমানায় বাংলা মাধ্যম হাই স্কুলের জন্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইংরেজি পাঠ্যক্রম থেকে নেওয়া কিছু পাঠ্য আলোচনা করব যাতে রাজনৈতিক পালাবদলেও এই পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শগত ধারাবাহিকতা নজরে পড়ে।
বামফ্রণ্টের আমল থেকেই অষ্টম শ্রেণীর জন্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইংরেজি পাঠ্য পুস্তক ‘Learning English’-এর নবম অধ্যায় Pandora’s Box । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিক্ষার্থীরা এই অধ্যায় থেকে শিখছে যে, অবাধ্য মেয়েরা মাত্রাতিরিক্ত কৌতুহলবশে অনধিকারচর্চা ক’রে কেবল নিজের এবং সঙ্গীরই বিপদ ডেকে আনে না বরং সারা সমাজ তথা পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি করে। সুতরাং সমাজের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ নারী স্বাধীনতা এবং মেয়েদের ইচ্ছেমত গতিবিধি। আদতে গ্রীক মিথ বা উপকথা হলেও, যখন এই কাহিনী শিশুদের পড়ানো হয়; যখন একই বইতে বিজ্ঞানের খবর, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, দেশের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি বিষয়ে নানা পাঠ্য থাকে, তখন তারই পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত এরকম কোনো মিথকেও দৈনন্দিন বাস্তব মনে হতে পারে। ইন্টারনেটের যুগে যখন আমরা প্রাপ্তবয়স্করাই সত্য, অর্ধসত্য আর অসত্য -এর মধ্যে ফারাক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাই, তখন সরল শিশুরা বই-এর কথাকে মিথ্যে ভাববে কোন সাহসে!
লিঙ্গ সচেতনতার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে, ফলাফল বিবেচনা না করেই, পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করার ‘ট্রেন্ড’ রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে কখনই বদলায় না। তাই বামফ্রণ্ট জমানার পর বর্তমান সরকারের আমলেও দেখি একইরকম লিঙ্গ-অসচেতন পাঠ্য নির্বাচন - সপ্তম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্যবই-এর অষ্টম অধ্যায় The Story of Proserpine। এটিও উৎপত্তিগতভাবে গ্রীক মিথ। কিন্তু এই প্রচলিত মিথটির কাহিনী-সংস্করণে গল্পের বিষয়বস্তু যা দাঁড়ায় তা হল, এক নাবালিকা নিজের ক্ষুধা নিবৃত্তির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি সংযত রাখতে না পারার অপরাধে কীভাবে তার ধর্ষক এর সাথে প্রতি বছর মিলিত হতে বাধ্য হয়। বলাই বাহুল্য এই ধর্ষণের কোনও শাস্তি বিধান হয় না। এমনকী প্রোসারপাইন এর সঙ্গীরা, যারা কিনা তার অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তারাও তার ‘সিঙ্গেল মাদার’ সেরেস কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনা। তাহলে কি প্রোসারপাইনের এর উচিত ছিল তার ধর্ষক প্লুটো-র গৃহে আমরণ অনশন করা? এমন পাঠ্য স্কুলের কিশোর-কিশোরীর কাছে এরকম বার্তাই কি পৌঁছে দেয় না?
ওই একই পাঠ্য পুস্তক এর চতুর্থ অধ্যায় The Beauty and the Beast। এখানে দেখানো হচ্ছে কীভাবে একজন পিতা নিজের প্রাণ বাঁচাতে কন্যাসন্তানকে অপর এক পুরুষের হাতে তুলে দেন। শর্তে আবার এ-ও বলা আছে যে কন্যাকে “স্বেচ্ছায়” পরগৃহে যেতে হবে - পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিবাহ ব্যবস্থার আদর্শ প্রতিফলন!
পাশাপাশি যদি পাঠ্য বইয়ের অন্য কয়েকটি বিশেষ অধ্যায় দেখা যায় তবে একটি বিপরীত চিত্র উঠে আসবে। পাঠ্যবইতে ছেলেদের কেমন ক’রে দেখানো হচ্ছে? যেমন, অষ্টম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্য বইয়ের প্রথম অধ্যায় The Wind Cap - এখানে জন নামের বালক তার ইচ্ছেমত বাড়ির বাইরে রোমাঞ্চকর অভিযানে যায় আবার বাড়িতেও সময় কাটায়। বা ধরা যাক, ওই একই পাঠ্য বইয়ের সপ্তম অধ্যায় A King’s Tale। এখানে ইংল্যান্ড এর কিংবদন্তি রাজা আর্থার এর শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন এর যাবতীয় রোমাঞ্চকর ঘটনা বলা হয়েছে। অর্থাৎ যেসব গল্পের কেন্দ্রে মূলত মেয়েরা আছে, তা হয় মেয়েটির নিজের অথবা তার দ্বারা ঘটানো কোনও বিপদ বা দুর্দশা। আর উইন্ড ক্যাপ বা কিংস টেল-এর মত গল্পে যেখানে ছেলেরাই মূল চরিত্র, সেখানে কিন্তু বাধা-নিষেধ, বিপদ বা দুর্ভোগের চিহ্নমাত্র নেই। আর থাকলেও সেটা দুঃসাহসিকতার সাথে জয় করার কাহিনীই পাঠ্যের মূল প্রতিপাদ্য।
সবশেষে, একাদশ শ্রেণির ইংরেজি বইতে মাদার টেরেসা-র Noble Lecture –এর কথা বলি। প্যান্ডোরা-র সূত্র ধরেই বলছি, এখানেও জগতের যাবতীয় অশান্তির মূল কারণ ধরা হয়েছে মহিলাদের, যারা আত্মসংযমের অভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে এবং পরে গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়। এখানেও যাবতীয় দায়িত্ব মহিলাদেরই এবং বলাই বাহুল্য, পুরুষদের দায় প্রায় নেই বললেই চলে।
স্কুলস্তরে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাকি জীবন ধরে এই চিন্তাভাবনা কীভাবে প্রভাব ফেলছে তা শুধুমাত্র ইংরেজি পাঠ্যক্রম নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতেই খানিকটা বোঝা যায়। শিক্ষার বাইরের চমক দিনের পর দিন বাড়ছে, শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বাড়ছে - কিন্তু কী শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম, সেটা আমরা আদৌ ভাবছি তো?
Link: https://ebongalap.org/school-syllabus-gender-discrimination