23-05-2024 01:29:37 am

print

 
Ebong Alap / এবং আলাপ

এবং আলাপ

জেন্ডার | সমাজ | নাগরিকত্ব

Ebong Alap

Gender | Society | Citizenship

 

যে ভাষা আমারও : প্রসঙ্গ ভাষার লিঙ্গায়ন


Satabdi Das
https://ebongalap.org/author/satabdi-das/
February 21, 2019
 

Link: https://ebongalap.org/sexism-in-everyday-language

ভাষাদিবসে লিখতে বলা হয়েছে ভাষার লিঙ্গায়ন ও লিঙ্গায়িত ভাষা নিয়ে।  প্রথমেই মনে হল, ‘পিতৃভূমি’ যদি বা শুনেছি, ‘পিতৃভাষা’ হয় না কেন? চুক্কি খেয়ে গেছে কি পিতৃতন্ত্র? তা নয়। যা কিছু আবেগ-অনুভূতি, সাবলীলতা-কমনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাকে নারীর রূপকে ভাবার অভ্যেস আমাদের। তাই যে ভাষায় যাবতীয় হাসি-কান্না, তা ‘মাতৃভাষা’।

লাকাঁ বলেছিলেন, ভাষার গঠন অবচেতনের মতো। ফ্রয়েডের মতে অবচেতনের মূল সঞ্চালক  যৌনতা। লাকাঁর মতে তা নয়। বরং এমনকী মানুষের অবচেতনেও ভাষা-সংস্কৃতি-মানবিক আন্তঃসম্পর্ক ইত্যাদি সামাজিক উপাদানগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না৷

ভাষার লিঙ্গায়ন আসলে বিভিন্ন পদের(parts of speech) লিঙ্গায়নের থেকে শুরু হয়। বাংলায় এখন শুধু বিশেষ্য পদ কম-বেশি লিঙ্গায়িত, আগে বিশেষণও তাই ছিল। হিন্দিতে সেইসঙ্গে ক্রিয়াপদ লিঙ্গায়িত। ইংরেজিতে পাই লিঙ্গায়িত সর্বনাম(He,She, It), যা বহু দিন ধরেই তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রাচীন ভাষাগুলিতে এই লিঙ্গায়ন আরো নানা পদে প্রকট৷ ভাষা যত সরল হয়েছে, লিঙ্গায়নের প্রভাব ব্যকরণগত ভাবে কমেছে। কিন্তু 'জেণ্ডার-রোল' বা সামাজিক-লিঙ্গ-ভূমিকার পরিবর্তন ঘটতে এখনও ঢের দেরি। ভাষাও এই বৈষম্য বহন করছে।

লিঙ্গভিত্তিক হিংসাকে যদি আমরা একটা পিরামিড হিসেবে কল্পনা করি, তবে তার শীর্ষবিন্দুতে রাখতে হবে নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের জীবনহানি-কে। ঠিক তার পরের ধাপেই থাকবে তাদের উপর যৌন অত্যাচার। তারপর নামতে নামতে সেই পিরামিডের শেষ ধাপ বা ‘ভূমি'-তে অবশ্যই থাকবে লিঙ্গায়িত ভাষা, যা বিভেদকে মননে, মেধায়, চিন্তনে,সংস্কৃতিতে চিরস্থায়ী করছে।

পানীয়-র বিজ্ঞাপনে একটা সপ্রশ্রয় বাণী থাকত -’Men will be men’ বহুদিন পরে মুলায়ম সিং যাদব প্রায় একই সুরে ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন- ‘ছেলেরা ভুলচুক করেই ফ্যালে।’  কোনো কাজে সফল হলে শোনা যায়- ‘এইতো ব্যাটাছেলের মতো কাজ!’ কখনো অবশ্য মেয়েদের উত্যক্ত করাকেও এরকম প্রশংসনীয় পুরুষোচিত কাজ ভাবা হয়৷ ক্রিকেটার হার্দিক পান্ড্য যেমন বলেছিলেন, নাইটক্লাবে নানা যৌন অভিযানের পর বাবা-মা পিঠ চাপড়ে  ‘প্রাউড অফ ইউ’ বলেন।

মেয়ে হয়েও কেউ পরিবারের দায়িত্ব নিলে বাবা-মা খুশি হয়ে বলেন- ‘ও তো আমাদের ছেলে-ই।’  যুক্তিবাদী প্রবন্ধ লিখলে শুনতে হয়, ‘বোঝাই যায় না কোনো মেয়ের লেখা!’ পুরুষ গৃহকর্ম করলে  ‘তোমার বর রাঁধতেও পারে!’ ধরনের আপাত-নিরীহ বিস্ময় দুর্লভ নয়। মেয়ের মায়েরা ‘কপাল ভালো!মেয়েরা তো শান্ত হয়!’ ধরনের শুভেচ্ছা পান। ‘মেয়ে তোমার একদম ছেলেদের মতো চৌকশ’-ধরণের প্রশংসাও জোটে। ‘মেয়ে হলেও অঙ্কে ভালো’, ‘মেয়ে হলেও ফুটবলার’, ‘মহিলা-ক্রিকেট’, ‘মেয়ে-ডাক্তার’ এসব তো চলতি ভাষার অংশ৷ অন্যদিকে শোনা যায়, ‘Be a man’, ‘Have guts’, ‘ছেলেদের  কাঁদতে নেই’। যদিও ১৬-২৪ বছর বয়সী ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার দেখে মনে হয়, বিশেষত শেষ বাক্যটির বোঝা বওয়া বড় কঠিন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের ম্যানিফেস্টোয় ‘ছাপান্ন ইঞ্চির বুক’ উল্লিখিত হয়। তাঁর বিপক্ষ রাহুল গান্ধী বলেন, তিনি নাকি এক মহিলার (প্রতিরক্ষামন্ত্রী-র কথা বলা হচ্ছে) পিছনে লুকিয়ে পড়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প যত্রতত্র নারীবিদ্বেষী ভাষা ব্যবহার করেন।  ভাষার নিপীড়ন ক্ষমতাকে সন্দেহ করা তাই অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ে।

কিউ নির্মিত তথ্যচিত্র ‘নবারুণ’-এ সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য, প্রতিস্পর্ধী বিপ্রতীপ সংস্কৃতির স্বর, বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষাকে emasculate করেন।’ প্রকারান্তরে বলেন, রবীন্দ্র-পূর্ববর্তী পৌরুষের ভাষা তিনি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, কারণ তাঁর শৈল্পিক স্ট্র্যাটেজিতে সেটাই প্রয়োজনীয়।  অর্থাৎ বলতে চাইলেন, প্রতিস্পর্ধার ভাষা হবে পুরুষালি, লালিত্যবর্জিত, দৃঢ়,কাঠখোট্টা, আক্রমণাত্মক। লেখক চান কি না চান, এরকম ভাষায় থাকতে পারে কিছু প্রকট নারীবিদ্বেষ, কিছু প্রচ্ছন্নভাবে নারীবিদ্বেষী খিস্তি - কারণ এসবও পুরুষালি ভাষারই ধর্ম।

স্বাভাবিকভাবেই, শ্রেণিশত্রু-র প্রতি ফ্যাতাড়ুদের  বারুদ উদগীরণের অন্যতম নমুনা -

‘ঢেঁপসিরা পেপসিতে লাগায় চুমুক

ইয়া বড় পাছা তার

তত বড় বুক।’

লক্ষ্যনীয়, পুরুষের পুরুষকেই খিস্তি করার ভাষায় যদি থাকে যৌনতা বা ধর্ষণের ইঙ্গিত, তা আসলে অন্যান্য লিঙ্গের প্রতিই অবমাননাকর হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। আর যদি তা না থাকে, তবে সেসব খিস্তি আদৌ তেমন তীব্র হয় না।  পুরুষের জন্য ব্যবহৃত একটি নারীবিদ্বেষহীন খিস্তি হল ‘ঢ্যামনা’, অর্থাৎ নির্বিষ। পুরুষবাচক ‘মিনসে’ নিস্তেজ গালি। ‘মাগ’ নেহাতই নিরীহ একটি শব্দ। কিন্তু উৎপত্তিগত ভাবে অশালীন না হলেও ‘মাগী’ শব্দটি বেশ্যা অর্থে ব্যবহৃত হয়। পুরুষবাচক খিস্তিতে তেমন ঝাঁঝালো অভিঘাত চাইলে, চার-অক্ষর-পাঁচ-অক্ষরই ভরসা, কারণ সেক্সিস্ট না হলে খিস্তি জমে না।

অপছন্দের মেয়েকে ‘খানকি’ বলা যায়, অপছন্দের ছেলের জন্য পুরুষ-দেহব্যবসায়ীর  প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয় না। তাকে ‘খানকির ছেলে’ বলে । মা তুলে গালাগালি সব ভাষায় পুরুষকে অপমানের অন্যতম স্বীকৃত উপায়৷

‘তিনি বেশ্যালয়ে যান’, এই বাক্যে ‘বেশ্যা’ খিস্তি নয়। কিন্তু ‘বেশ্যার জাত’ বললে তা খিস্তিই বটে। ‘বেশ্যা'-র অর্থসম্প্রসারণ অত্যন্ত রাজনৈতিক।  সীমানালঙ্ঘনকারী যেকোনো নারী,সে ছোট জামাকাপড় পরুক, চাকরি করুক বা মুখে মুখে তর্ক করুক, সে ‘বেশ্যা’ বা ‘খানকি’ বা ‘রেন্ডি’ বলে অভিহিত হতে পারে। ইংরাজিতে ‘ডগ’ হল সারমেয় মাত্র, কিন্তু ‘বিচ’ বলতে বোঝায় বহু পুরুষের শয্যাসঙ্গিনীকে। অর্থাৎ নারীর স্বেচ্ছা-যৌনতা চিরকালই খিস্তির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবিন্দু। অপরদিকে, আজও বিশিষ্ট অধ্যাপক কুমারী মেয়েকে প্রকাশ্য আলোচনায় ‘সিলড বটল’ বলে ডাকেন।

পুরুষের যৌনাঙ্গের একাধিক প্রতিশব্দও পাওয়া যায় খিস্তির ক্যাননে। পুরুষাঙ্গই যেন  পুরুষের শক্তি তথা দুর্বলতার নিয়ামক। যথেষ্ট পুরুষ নয় বোঝাতে ব্যবহৃত স্ল্যাং হল ‘দাঁড়ায় না’। ৷ ‘হিজড়া’ হল পৌরুষের অভাব বোঝাতে ব্যবহৃত  গালাগাল,যা সরাসরি তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি অবমাননাকর। ‘ছক্কা’ ব্যবহৃত হয় সমকামীদের জন্য, মেয়েলি পুরুষদের জন্য ‘বৌদি’। ‘গাঁড় মেরে দেওয়া’-র অর্থ জব্দ করা,অথচ তার মধ্যে বলপূর্বক পায়ুমৈথুনের ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ রেপ-রেটরিক, সেক্সিস্ট ও  নারীবিদ্বেষী রেটরিক তাহলে প্রায়শই আমরা ব্যবহার করে থাকি প্রচলিত ভাষায়।

তবে, খিস্তির ক্ষেত্রে অবশ্য অনেকে প্রয়োগের থেকে তার উৎসকে আলাদা করতে ভালবাসেন৷ খিস্তির মাধ্যমে বঞ্চনার উপশম খোঁজে  প্রোলেতারিয়ত, এমনও বলেন অনেকে৷ কেউ বলেন, গালি হল ভাষার সীমাবদ্ধতা পেরোনোর জন্য ‘exaggerated metaphor’। কিন্তু মেটাফোর হোক বা বঞ্চনা থেকে উত্তরণ, তার প্রকাশভঙ্গি যদি অপর লিঙ্গের প্রতি অবমাননাকর হয়, তবে তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন৷  উৎসে সীমাবদ্ধ থেকে যেমন ভাষার প্রচলিত রূপকে অস্বীকার করা যায় না, তেমনই উৎসকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়াও একরকম ভাবে সমাজ-মানসকে ধামাচাপা দেওয়া৷

বরং আমরা স্ল্যাং, গালি তথা সাধারণ ভাষাকে রিক্লেইম করতে পারি৷ যেমন  ইংরাজিতে ‘ভার্জিন’ মানে ছিল যৌন-অভিজ্ঞতা-পূর্ব নারী৷ কিন্তু এখন যৌন-অভিজ্ঞতাহীন পুরুষের ক্ষেত্রেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ‘লুজিং ভার্জিনিটি’ বলতে সম্মত যৌনতায় প্রথম অংশগ্রহণ বোঝায়, নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ সবার ক্ষেত্রেই। এই শব্দটিকে যেমন রিক্লেইম করা গেল, বাংলায় ‘সতী’ শব্দটির কিন্তু তেমন  রদবদল হয়নি৷ একই সঙ্গী-তে অনুরক্ত নারী যদি ‘সতী’ হয়, মোনোগ্যামাস পুরুষকে তবে বাংলায় কী বলে?

কোনো ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ, শব্দের অর্থ দ্বারা সেই ভাষাভাষীর সমাজিক অবস্থা,  ব্যক্তির মানসিক অবস্থা প্রকাশ পায়৷ একই ভাবে, কোনো ভাষা থেকে, শব্দ থেকে সেক্সিজম দূর হচ্ছে মানে, বুঝতে হবে, সেই সমাজও একটু একটু করে সেক্সিজম-মুক্ত হচ্ছে। মানব-মস্তিষ্কের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অবিন্যস্ত আওয়াজ থেকে ক্রমে ভাষা এসেছে।  তা চিন্তার বাহন হয়েছে। যত চিন্তনক্ষমতা বেড়েছে, সমাজ-সংস্কৃতি জটিল হয়েছে, তত ভাষাও জটিল হয়েছে।  সমাজ ও সংস্কৃতি অনুসারেই গড়ে উঠেছে ভাষাটির স্ট্রাকচার, ভাষার শব্দগুলোর অর্থ। সেই স্ট্রাকচারের বাইরে গিয়ে চিন্তা করা তারপর কঠিন হয়েছে। কারণ চিন্তার জন্য শব্দ লাগে, শব্দের অর্থ লাগে। যে শব্দ বা শব্দের অর্থই এখনও ভাষায় আসে নি, তার দিকে সাধারণ মানুষের চিন্তা ধাবিত হতে পারে না৷

সেপির হোর্ফ হাইপোথিসিজ নামে এক নীতি আছে, যাকে  প্রিন্সিপল অব লিংগুইস্টিক রিলেটিভিটিও বলে। তা অনুসারে, একটা ভাষার স্ট্রাকচার সেই ভাষাভাষী মানুষের বিশ্বচেতনা এবং বোধগম্যতাকে( cognition) প্রভাবিত করে। মুশকিল হল, এর আরেক নাম লিংগুইস্টিক ডিটারমিনিজম। ভাষাকে প্রায় নিয়তির মতো ক্ষমতাশালী ভাবা হয়েছে এখানে৷

কিন্তু সমাজ বিবর্তনের ধাপে যখন নতুন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন সমাজ নিজে থেকেই নতুন শব্দ তৈরি করে, শব্দভাণ্ডারের শব্দগুলিও নিজেদের অর্থের পরিবর্তন ঘটায়- এরকম নজিরও অনেক আছে। ভাষাও অভিযোজিত, বিবর্তিত হয়।  সস্যুরের স্ট্রাকচারালিজম যেহেতু বুঝিয়েছিল, ভাষার স্ট্রাকচার মানুষের চিন্তাধারাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে, সেইহেতু পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম স্ট্রাকচারের-ও বাইরে গিয়ে চিন্তা করার প্রয়াস নেয়।

তাই সমাজকে নতুন ছাঁচে ঢালতে গেলে তার ভাষাতেও নজর দিতে হবে। ইংরেজিতে আগে পুলিসম্যান, ফায়ারম্যান, চেয়ারম্যান শব্দগুলো ব্যবহৃত হত।  শব্দগুলোর স্ট্রাকচারেই পুরুষবাচকতা। এখন এসেছে জেন্ডার নিউট্রাল পুলিস অফিসার, ফায়ার ফাইটার, চেয়ারপার্সন। বিচ, হোর, স্লাট, কান্ট ইত্যাদি কিছু অবজ্ঞাসূচক শব্দ নিয়ে আগেই বলেছি। তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদী ইংগা মুশিও বলেছিলেন, এই শব্দগুলোকে অধিগ্রহণ করে,বহুল পরিমাণে ব্যবহার করে, সাধারণ প্রয়োগে আনতে হবে। এই পথ ধরেই  এলিজাবেথ উর্জেল ‘বিচ: ইন প্রেইজ অব ডিফিকাল্ট উইমেন’ লেখেন, সেখানে ‘বিচ ফিলোসফি’-র কথা বলেন। এই পথ ধরেই সারা বিশ্বে ‘স্লাট-ওয়াক’। ভাষাগত আরও নানা বিবর্তন লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে।

সেই অনাগত আগামীর অপেক্ষায়, অনাগত ‘আমার’ ভাষার অপেক্ষায়, মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা!

Link: https://ebongalap.org/sexism-in-everyday-language

print

 

© and ® by Ebong Alap, 2013-24