08-03-2024 17:26:05 pm
Link: https://ebongalap.org/sexuality-and-mahabharata
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। ব্যাসদেবের নাতিপুতিরা সব মৃত। প্রপিতামহ ব্রহ্মা এলেন ব্যাসের কাছে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে মহাভারত লিখতে বললেন। এই মহাকাব্যের অনুলেখক হিসাবে গণেশের নাম প্রস্তাব করলেন। ব্যাসদেবের কথা শুনে শুনে গণেশ লিখতে শুরু করলেন। গণেশ কে? অনেক কাহিনির মধ্যে অন্যতম হল, পার্বতী ও গজাননা নামের দুই রাক্ষসী মিলে গণেশের জন্ম দেন। দুজন নারী সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন এমন কাহিনি কৃত্তিবাসী রামায়ণেও আছে। সুর্যবংশের রাজা দিলীপ অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর দুই বিধবা পত্নী মহাদেবের আদেশে পরস্পর সঙ্গমে লিপ্ত হন। যথাকালে তাঁরা এক পুত্রের জন্ম দেন, তাঁর নাম ভগীরথ। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে আছে, সন্তানের অস্থি আসে পিতার কাছ থেকে আর মায়ের কাছ থেকে সে পায় মাংস। ভগীরথের শরীরে তাই অস্থি ছিল না। মহাভারতের শান্তিপর্বে আছেঃ
অস্থি স্নায়ুশ্চ মজ্জা চ জানীমঃ পিতৃতো দ্বিজ।
ত্বঙমাংসং শোণিতঞ্চেতি মাতৃজান্যপি শুশ্রুম।। (৩০৫/৫)
অস্থি, স্নায়ু ও মজ্জা পিতা থেকে এবং ত্বক, মাংস ও শোণিত মাতা হতে পাওয়া যায়। ভগে-ভগে মিলনের ফলে ভগীরথ জন্মেছিলেন বলে তাঁর অস্থি প্রভৃতি ছিল না। একদিন অষ্টাবক্র মুনিকে সম্মান জানানোর জন্য ভগীরথ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। তাঁর বক্রাবস্থা দেখে মুনি ভাবলেন ভগীরথ তাঁকে অবজ্ঞা করছেন। মুনি শাপ দিলেন, যদি তুমি আমাকে বিদ্রুপ করো, তাহলে বিকলাঙ্গ হও; নচেৎ তুমি উত্তমাঙ্গ হও। ভগীরথ সুন্দর দেহের অধিকারী হলেন। অষ্টাবক্র মুনিও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছিলেন। সমঙ্গা নদীতে স্নান করে তিনি সুন্দর দেহ পান।
‘দ্রুপদপুত্র’ শিখণ্ডী নারী হয়ে জন্মান। পিতামাতা তাঁকে সামাজিক ভাবে পুরুষ হিসাবে বড় করেন। এমনকি তাঁর বিবাহ দেওয়া হয় রাজা হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে। সেই নারী প্রতারণার অভিযোগ জানালে শিখণ্ডী মনের দুঃখে বনে গিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। সেই বনে বাস করতেন স্থূণাকর্ণ নামের এক যক্ষ, তিনি লিঙ্গান্তরের নিয়ম জানতেন। সব কথা শুনে স্থুণাকর্ণ শিখণ্ডীকে পুরুষ করে দেন। শিখণ্ডী ফিরে আসেন রাজ্যে এবং স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে থাকেন। ঋগ্বেদে নারী-সমকামবিষয়ক অনেক কাহিনি আছে। আনা গার্সিয়া অরোয়া অল্টারনেটিভ সেক্সুয়ালিটিজ ইন ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থে সে সব বর্ণনা করেছেন। ‘দ্যাবা’ হল দুই যমজ বোনের একত্রীকরণ, তাঁরা অগ্নির জন্মদাত্রী। ঊষাকেও তেমনভাবে দেখা হয়। দক্ষিণ ভারতে আদিকাল থেকে ‘জোগাপ্পা’ নামে একটি সম্প্রদায় আছে, যে সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মহিলাদের পেশা গণিকাবৃত্তি। জোগাপ্পা সম্প্রদায় ইয়েল্লাম্মা দেবীর পূজা করেন, যিনি দেবী দুর্গার একটি রূপ। জোগাপ্পা ও দেবদাসীদের একটি বড় অংশ সমকামী। কথিত আছে, লঙ্কা পরিভ্রমণের সময় হনুমান রাবণের হারেমে স্ত্রীদের আলিঙ্গনাবস্থায় দেখেছিলেন। তবে মনুস্মৃতিতে আছে, “যদি কোনও নারী অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারী (যার কৌমার্য আছে)-র সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে বয়স্কা মহিলার মস্তক মুণ্ডন করে দুটি আঙুল কেটে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে।” (৮/৩৭০)। আর “যদি দুই কুমারীর মধ্যে সমকামিতা স্থাপিত হয়, তাদের শাস্তি দুশো মুদ্রা জরিমানা এবং দশটি বেত্রাঘাত। (৮/ ৩৬৯)।
তুলনামূলকভাবে পুরুষ সমকামীদের শাস্তি কম। তবে নারী-সমকাম যে পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, তা নয়। কুমারীদের জন্যই শুধু এই নিষেধাজ্ঞা। মনুস্মৃতি পুরুষ-সমকামীদের বিষয়ে বলেছে, “দুজন পুরুষ অস্বাভাবিক কামে প্রবৃত্ত হলে তাদের জাতিচ্যুত করা হবে (১১/১৭৫)। ‘শুশ্রুত-সংহিতা’ নামক প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রেও সমকামিতার প্রসঙ্গ আছে। এই গ্রন্থে দুই প্রকার পুরুষ সমকামীর উল্লেখ আছে—কুম্ভিক ও অশক্য। যাঁরা পায়ু সঙ্গমে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাঁরা কুম্ভিক আর সক্রিয়রা হলেন অশক্য। নতুন চাঁদ এবং পূর্ণিমা নরনারীর মিলনের জন্য প্রশস্ত নয়, এই রাত দুটি ‘অন্য’ সঙ্গমের পক্ষে উপযুক্ত, যাকে বলা হয় ‘চিত্ররত’। মহাভারতে মনুস্মৃতি এবং সুশ্রুত দুয়ের উল্লেখ আছে।
কৃষ্ণ একবার অর্জুনকে এক পবিত্র সরোবরে স্নান করতে বলেন। অর্জুন জলে নেমেই মহিলা হয়ে যান, তাঁর নাম হয় ‘অর্জুনী’। পদ্মপুরাণে আছে, পুরুষ কৃষ্ণের সঙ্গে অর্জুনী কামক্রীড়ায় মেতে ওঠেন। পুনরায় তাঁকে পূত সরোবরে স্নান করতে অনুরোধ করলে অর্জুনী পুরুষত্ব ফেরত পেয়ে অর্জুন হয়ে ওঠেন। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতি ভাব গোপন করতে পারেন না। কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর পৌরুষ সম্পর্কে অবহিত ও নিবারিত করেন।
মহাভারতের অনুশাসনপর্বে আছে, অগ্নি সকল দেবতার প্রতীক—অগ্নির্হি দেবতাঃ সর্ব্বাঃ। অগ্নি তাঁর পেটের রোগ সারানোর জন্য কৃষ্ণার্জুনের সাহায্যে খাণ্ডববন দহনের মাধ্যমে ভক্ষণ করেন। স্বাহার পত্নী অগ্নির সঙ্গে সোম দেবতার সমকামী সম্পর্ক ছিল। অগ্নি সোমের বীর্য মুখে ধারণ করেন। কার্তিকেয়র জন্ম বিষয়ে পুরুষ সমকামকে দায়ী করা হয়।
বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতে মিত্র ও বরুণ দুজনেই দেবতা। তাঁরা দুজনেই সমকামী। সন্তানের জন্মও দিয়েছিলেন। নারদস্মৃতিতে অবশ্য আছে, যেসব পুরুষরা পরস্পর মুখসঙ্গম করেন, তাঁরা মহিলাদের বিবাহ করতে পারবেন না, ধর্ষিতা নারীকেই তাঁরা বিবাহ করতে অযোগ্য (নারদস্মৃতি ১/১২/১৫)। মিত্র ও বরুণ অসমকামীও ছিলেন যেমন ছিলেন অর্জুন ও শিখণ্ডী। আবার অগ্নির স্ত্রী আছে। রাজা দিলীপের দুই স্ত্রী পুরুষ-সংসর্গও করেছেন। এঁরা হলেন উভকামী। দেবতাদের সমুদ্র-মন্থনের সময় অমৃত, সোমরস প্রভৃতি পাওয়া গিয়েছিল। উভকামী কল্পনায় বহু বহু দেবতা তাঁদের লিঙ্গ পরিবর্তন করেন। তবে উভকামী হতে গেলে যে লিঙ্গ পরিবর্তন করতেই হবে, এমন কোনও নিয়ম নেই। একই ব্যক্তি যদি সম ও বিষম কামে লিপ্ত হতে পছন্দ করেন, তবেই তিনি উভকামী। এমন চরিত্র মহাভারতে অনেক আছে। রাজার মহিষীদের মধ্যে এমন সম্পর্ক বিরল নয়।
রূপান্তরকাম মহাভারতের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। রাজা ভঙ্গাস্বন এবং শিখণ্ডীর কথা সকলেই জানেন। ভঙ্গাস্বন মৃগয়ায় গিয়ে সরোবরে স্নান করে উঠে দেখেন তিনি নারী হয়ে গিয়েছেন। তার পর এক তপস্বীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পুত্র উৎপাদন করেন। পুরুষ ভঙ্গাস্বনের ছেলেরা রাজপুত্র। তাঁদের কাছে নারী ভঙ্গাস্বনের ছেলেদের পাঠানো হল। কিন্তু রাজার ছেলেরা তপস্বীর ছেলেদের রাজত্ব দেবে না। এই নিয়ে অনেক হাঙ্গামা, মারামারি, হত্যালীলা। ভঙ্গাস্বনকে পরে পুরুষত্ব ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি নারী হয়েই থাকলেন কারণ তাঁর মতে নারী অবস্থায় সঙ্গমের সুখ অনেক বেশি তীব্রতর। শিখণ্ডী যক্ষের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করেন। অর্জুনের অর্জুনী কিংবা বৃহন্নলাতে রূপান্তরিত হওয়া এক ধরণের রূপান্তরকামের উদাহরণ। ইলার উদাহরণ সর্বজনবিদিত। মহাভারতের একটি সংস্করণে পাওয়া যায়, এক পূজাতে নরবলি দেওয়ার জন্য নিখুঁত মানুষ খোঁজা হচ্ছিল। কৃষ্ণ, অর্জুন ও ইরাবান ছাড়া আর কেউ খুঁতহীন ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ইরাবানকে বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তাঁর শেষ ইচ্ছা কী, এই প্রশ্নের জবাবে অর্জুন-উলূপীর পুত্র অবিবাহিত ইরাবান বিবাহ করে স্ত্রীসঙ্গমের ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু কোন পিতা ইরাবানকে কন্যা সম্প্রদান করবেন, যখন জানা কথা যে বিবাহের পরেই কন্যাটি অতি শীঘ্র বিধবা হবেন? মুশকিল আসান করলেন ভগবান। তিনি কৃষ্ণরূপ ছেড়ে স্ত্রী মোহিনীরূপ ধরে ইরাবানকে বিবাহ করে তুষ্ট করলেন। ইরাবানের মৃত্যুর পর ওই মোহিনী স্ত্রীলোকের মতো হাউ-হাউ করে কেঁদেছিলেন।
রাজা যুবনাশ্ব পুরুষ হয়ে গর্ভধারণ করেছিলেন এবং মান্ধাতাকে প্রসব করেন। শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তির কথা সকলেই জানেন।
যোগিনী সুলভা মহাভারতে জনক রাজার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে একটি কথা বলেছিলেন, ধর্ম এবং কাম পুরুষ (male) কেন? লক্ষ্মী আর মুক্তিই বা স্ত্রী কেন? এই চার পুরুষার্থকে কেন্দ্র করে জগৎ চলে। পুরুষ (individual)-এর অর্থ বিষয় হল পুরুষার্থ। জনক রাজা পরাজিত হয়েছিলেন। সুলভা তাঁকে লিঙ্গপরিচয়ের উর্ধে উঠে সাধনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
Link: https://ebongalap.org/sexuality-and-mahabharata