09-03-2024 00:00:02 am
Link: https://ebongalap.org/sita-ecofeminism
অথ মে কৃষতঃ ক্ষেত্রং লাঙ্গলাদুস্মিতা ততঃ
ক্ষেত্রং শোধয়তা লব্ধা নাম্না সীতেতি বিশ্রুতা।।
একদিন ক্ষেত্রকর্ষণ করতে করতে লাঙ্গলের রেখা থেকে একটি কন্যাকে পাই। ক্ষেত্রশোধন কালে হলরেখা থেকে উৎপন্ন বলে লোকে তাকে সীতা বলে।
একটু খেয়াল করলে দেখতে পাব এই সীতার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই কীভাবে জড়িয়ে আছে মাটি, অরণ্য, জননী বসুন্ধরা। মাটি থেকে জন্ম, দাম্পত্যের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে অরণ্যে, অপহৃতা হবার পর রাবণের প্রাসাদ নয়, তাঁর আশ্রয় হয়ে ওঠে একটি শিশংপা বৃক্ষ। সীতা যে অরণ্য প্রকৃতির সঙ্গে কতটা মিশে ছিলেন তা বোঝা যায় সীতাকে হারানোর পর রামের বিলাপে (এমন বিলাপকাতর মহাকাব্যের নায়ক আর দুটি আসেননি)।
'কদম্ব, আমার প্রিয়া তোমাকে ভালবাসেন, তাঁকে দেখেছ? অশোক আমি শোকে চেতনাহীন হয়েছি, প্রিয়াকে দেখিয়ে শীঘ্র আমার শোক দূর কর। কর্নিকার তুমি আজ পুষ্পিত হয়ে অতিশয় শোভিত হয়েছ, তুমি আমার প্রিয়ার প্রিয়, সেই সাধ্বীকে দেখে থাক তো বল।'
শোকমগ্ন রামকে লক্ষ্মণ সান্ত্বনা দেন এই বলে, ‘মৈথিলি বনে বিচরণ করতে ভালবাসেন, হয়ত তিনি বনে বা কমল ভূষিত সরোবরে বা মৎসবহুল নদীর কাছে গেছেন।’
জটায়ুকে বধ করে রাবণ যখন সীতাকে ধরতে আসছিলেন, সীতা একটি গাছকেই জড়িয়ে ছিলেন। বহু বহু যুগ পরে আমরা দেখব চিপকো আন্দোলনের রমণীদের যারা এক-একটি গাছকে জড়িয়ে তাদের কুঠারাঘাত থেকে রক্ষা করেছিল। এমনকি লঙ্কায় রাবণের মিলনকামনাকে ঠেকিয়ে রাখতে সীতা তাঁর ও রাবণের মাঝখানে রেখেছিলেন একটিমাত্র তৃণকে। অর্থাৎ সীতা নিছক সৌখিন পরিবেশপ্রেমী নন, আধিপত্যকামীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেও তিনি পরিবেশকে ব্যবহার করতে পেরেছেন সার্থকভাবে। এবং সীতাকে মূলধারার গণমাধ্যমে সর্বংসহা হিসেবে তুলে ধরা হলেও আড়ালে থেকে যায় তাঁর প্রতিবাদী চরিত্র। তাঁর প্রতিবাদ রামের অকারণ অস্ত্রধারণের বিরুদ্ধে। রামকে তিনি সাবধান করে বলেছিলেন, তিনি যেন অকারণ রুদ্রতা (ক্রোধ ও হিংস্রতা) দেখিয়ে অরণ্যের পরিবেশ নষ্ট না করেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন ‘কোথায় অস্ত্র আর ক্ষাত্রধর্ম, কোথায় বন আর তপস্যা। পরস্পরবিরোধী কর্মে লিপ্ত হওয়া অনুচিত, যে দেশে আছি সেই তপোবনের ধর্মই আমাদের পালনীয়।’
সেই হিসেবে শুধু পরিবেশ সুরক্ষা নয়, নিরস্ত্রীকরণেরও উজ্জ্বল মুখ সীতা। অথচ নারী ও প্রকৃতির সম্পর্ককে পশ্চিমে যখন রীতিমত তত্ত্বের চেহারা দেওয়া হল তখন কোথাও ঠাঁই হল না সীতার ।
ইকোফেমিনিজম। এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ফরাসী নারীবাদী ফ্র্যাংকুইজ দা ইয়াবন্নে তাঁর ‘ফেমিনিজম অর ডেথ’ গ্রন্থে ১৯৭৪ সালে। বিশ্বশান্তি, পরিবেশরক্ষা ও নারী আন্দোলন – এই তিন ধারা মিলে গেল ইকোফেমিনিজমে। ভারতের চিপকো বা বিশনই বা নর্মদা বাঁচাও প্রকল্প, কেনিয়ার সবুজ বন্ধনী আন্দোলন, জার্মানিতে পারমাণবিক প্ল্যান্টের বিরুদ্ধে কৃষক নারীর উত্থান—সবকিছুকে এক সুতোয় বেঁধে দিল ইকোফেমিনিজম। আমাদের মনে পড়তে পারে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর হাহাকার করে উঠেছিলেন এক রুশ মা –
‘পুরুষরা বোঝে শুধু যুদ্ধ আর প্রকৃতিকে জয় করা। নারী ধর্ষণের মতোই ওরা প্রকৃতিকে ধর্ষণ করে এসেছে এতদিন।’
প্রকৃতিকে ধ্বংস করে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার হোতা ছিলেন ফ্র্যান্সিস বেকন। যথেচ্ছ গাছ কাটা, নদী বাঁধ, বড় বড় যন্ত্র আর অপরিনামদর্শী অগ্রগতির ফল কী হল? মাত্রাছাড়া দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বিলুপ্ত প্রাণী আর বিপন্ন খাদ্যশৃঙ্খল। ইকোফেমিনিজম বলে এগুলো হচ্ছে পুরুষালি বিজ্ঞান ভাবনার ফসল যার মূল কথাই হচ্ছে আধিপত্য ও মুনাফা। যেভাবে পুরুষ নারীর নিজের শরীরের ওপর তার অধিকার খর্ব করেছে, তেমনভাবেই ব্যবহার করেছে প্রকৃতিকে, তার জন্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রকেও ব্যবহার করতে ছাড়েনি। এরই বিপরীতে দাঁড়িয়ে ইকোফেমিনিজম প্রকৃতির সুরক্ষায় নারীর বিশেষ ভূমিকার কথা শুধু বলে না, বলে ছোট প্রকৃতি-বান্ধব, বিকল্প প্রযুক্তির কথা, গ্রামীণ মহিলাদের হাতে তৈরি প্রযুক্তির কথা এবং যুগ যুগ ধরে নারী থেকে নারীতে চলে আসা ঐতিহ্যিক জ্ঞান বা traditional knowledge-এর কথা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। রাজস্থানের খরা প্রতিরোধে দারুণ কাজে এসেছে জল ধরে রাখার একটি কৌশল যা সেখানকার মেয়েরাই যুগ যুগ ধরে জানতেন। পরিবেশ যখন বিপন্ন তখন মেয়েদের কথা তো শুনতেই হবে। কারণ ‘women care, therefore they have the right to be heard, when the future of the planet is at stake.`
পশ্চিমী ইকোফেমিনিজম সীতাকে যেমন অন্তর্ভুক্ত করেনি, তেমনি তাদের আওতার বাইরে থেকে গেছে ব্রতকথার গ্রামীণ ও প্রান্তিক নারীরা। বাংলার মেয়েদের ব্রতকথা জুড়ে কেবলই প্রকৃতিকে জড়িয়ে মেয়েদের বেঁচে থাকার আখ্যান। এর পাতায় পাতায় শুধু বৃক্ষ লতা পাতা অরণ্যের বন্দনা। সাবিত্রী ব্রতে বটের ডাল লাগে, পুণ্যপুকুরে প্রধান উপকরণ তুলসী গাছ, দূর্বাষ্টমীতে দূর্বা, কুলকুলতি ব্রতে কুল গাছ, জাওয়া ব্রতে বিভিন্ন রবিশস্যের বীজ যেমন ধান, গম, জোয়ার, জনার, সরিষা, মুগ, কুথি। আরেকটি ব্রত ইতুলক্ষীর । ইতু মানে মিত্র। আর সূর্য ছাড়া মিত্র কেই-বা অসূর্যম্পশ্যা মেয়েদের? সেই ব্রতের উমনো–ঝুমনোকে যখন সৎ মায়ের প্ররোচনায় বনে রেখে এসেছিল বাবা, তখন তারা বৃক্ষ ছাড়া আর কার কাছেই বা প্রার্থনা জানাবে ‘হে বৃক্ষদেবতা, দু’-ফাঁক হও, আমরা তোমার মধ্যে আশ্রয় লাভ করি।’
শুধু বাংলার ব্রতকথা কেন, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জনজাতির নানান পার্বণে বন্দিত প্রকৃতি আর তার পুরোভাগে মেয়েরা। যেমন ঝাড়খণ্ডের বাহা পরব। অরণ্য ও শস্যবৈচিত্র্য সংরক্ষণে মেয়েদের এই সক্রিয় ভূমিকাটি চিরকালের উপেক্ষিত। এবং এটা সৌখিন প্রকৃতিপ্রেম নয়, মেয়েরা বারবার দেখা দিয়েছে প্রকৌশল সংরক্ষণ , এমনকি উদ্ভাবকের ভূমিকায়। কিন্তু সেই স্বর প্রায়শই অশ্রুত ও অস্বীকৃত। কে-ই বা জানে উত্তর-পূর্বের গারো জনজাতির মেয়েরা কমপক্ষে ৩০০ রকম ধানের খবর রাখেন, দুর্ভিক্ষের সময় সবার মুখে খাবার জোগায় মেয়েদের এই traditional knowledge, আর এ কথাটা শুনলে অনেকেই চমকে উঠবে, যে ঢেঁকির আবিস্কার কিন্তু বাংলার বধূদের হাতে। এর আগে প্রচলিত উদুখলের কাঠের মুগুরটি এত ভারি ছিল যে মেয়েদের পক্ষে তা টানা প্রায় দুঃসাধ্য। তাই অনেকদিন ধরে অনেক মেয়ের মিলিত চেষ্টায় এল ঢেঁকি। সে কথা আমরা জানি না শুধু পেটেন্টবিমুখ ভারতীয় মানসিকতার জন্য নয়, এর পিছনে আছে মেয়েদের কারিগরি মেধার প্রতি সমাজের অচলায়তনিক মনোভাব এবং পশ্চিমী উন্নাসিকতা ।
তাই ইকোফেমিনিজমে স্মরণ করা হয় না সীতাকে, গাছকে ভাই বলা রাজস্থানের খেজড়ি দেবী, কেরলের আদিবাসী মেয়ে সি কে জানু যে বলেছিল, ‘অরণ্য আমার মায়ের মতো’, কিংবা জারোয়া মেয়ে ইয়াম যার প্রার্থনায় পৃথিবীর সবার কল্যাণ কামনা থাকে, তাদেরও জায়গা হয় না। সীতা যা বহু শতাব্দী আগে বলেছিলেন, ১৯৬২ সালে তাই তো বললেন রাচেল কারসন তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ গ্রন্থে, অবশ্যই অন্য ভাষায়, অন্য ভঙ্গিতে। কিন্তু বক্তব্যটা এক। পৃথিবীর যাবতীয় অসুখের কারণ পুরুষতন্ত্রের অকারণ রুদ্রতা।
এখনো কি ইকোফেমিনিজমের ভারতীয় অধ্যায় লেখার সময় হয়নি?
Link: https://ebongalap.org/sita-ecofeminism