07-02-2024 19:36:25 pm
Link: https://ebongalap.org/story-of-a-working-woman-part-four
হ্যাঁ, আমরা মহিলারা পুরুষদের থেকে পে স্কেলে, কাজের বিবিধ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। কিন্তু ‘মানসিকতা’ নামক বিষয়টি তো রুলস রেগুলেশনের আওতায় পড়ে না। তাই কী কী দেখতে পাচ্ছি, বা পেয়েছি নিজের জীবনে, যা অন্য অনেক মহিলা অফিসারের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি?
পুরুষ উর্ধতন অফিসারের মনে, একটি মেয়ের কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে একটা সন্দেহের ভাব। যেটাকে কাটিয়ে উঠতে কখনো বা মহিলা অফিসাররা একটু বেশি বেশি কর্তব্যপরায়ণ, একটু বেশি বেশি নিজের কাজের ব্যাপারে কঠোর। নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে সর্বদা তাঁদের। নতুবা অদৃশ্য ছাপ্পা পড়ে যাবে পিঠে, তুমি তেমন দড়ো নও।
কোন অফিসার যদি বিবাহিত হন, এবং সন্তানবতী। তাঁর ক্ষেত্রে পরিবারের বিষয়ে কোন প্রি অকুপেশন থাকলে তো হয়ে গেল। পুরুষ বস, এমন কি মহিলা বসের চোখেও, সেই অধস্তন মেয়েটি তখন চূড়ান্ত অক্ষমতার প্রতীক, বিরক্তির সূচক। মাথা উঁচু করে, কোন অপরাধবোধহীনভাবে সন্তানের জন্ম দিতে দীর্ঘ ছ’ মাসের ছুটি নিতে আমি পারিনি, আমার মনে হয়েছিল আমার অফিস খুশি নয়। ঠিক যেমন ছ’ মাস পরে অফিসে ফিরে যেতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমার বাড়ি খুশি নয়। বাড়িতে এমন জল্পনাও শুনেছিলাম যে, এখন কি আর পারবে ন’টা-ছ’টা চাকরি করতে, এখন থেকে তো চারটের সময়ে ফিরে আসতেই হবে বাচ্চার জন্য।
বিবাহিত মেয়েরা, বিশেষত যাঁরা জীবনের একটা বড় পর্বেই এই দোটানায় চাকরি করেন। সবাই করেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কেউ এ নিয়ে আলোচনা করেন না। কোন হেল্পলাইনও মজুদ নেই। একা একাই এই গোটা সমস্যাটাকে নিজের মত করে যুঝতে যুঝতে জীবনের অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বছর কেটে যায়। যখন কাজের ক্ষেত্রেও ক্রমশ সিনিয়র হয়ে উঠছেন সেই মহিলা। ক্রমশ দায়িত্ব বাড়ছে।
যে কোনও মহিলা, যে সময়টায় সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, সন্তানকে মানুষ করছেন, তাঁদের টানাপোড়েনের যেন শেষ নেই। সংবেদনহীন পুরুষ উর্ধতন, এমনকি মহিলা উর্ধতনরাও, সন্তানকে সময় দিতে চাওয়া মেয়েটিকে নানাভাবে অসহযোগিতা করে যাবেন। অথচ, না, মেয়েটি তাঁর অফিসের কাজের যে সময় তাকে কোনভাবেই ফাঁকি দেন না। ন’টা থেকে ছ’টা অফিস করেন। নিজের করণীয় কাজের তালিকা ধরে ধরে শেষ করেন। তার পরেও, উর্ধতন অফিসারটি শনি রবিবার কাজে ডাকেন, বা রোজকার কাজের দিনে অনাবশ্যক সন্ধে অব্দি বসিয়ে রাখেন অধস্তন মহিলাকে, সাতটা-আটটা অব্দি কাজের ছুতোয় নিজের ঘরের উল্টোদিকের চেয়ারে। অফিসে কিছু সিজনাল কাজের চাপের সময়ে, আরো দেরি হয়। মেয়েটি বাড়ি ফিরতে পারেন না অনেক রাত পর্যন্ত। বাড়িতে সন্তানের দেখভাল করা শাশুড়ি বা অন্যান্যদের ভ্রুকুটি ক্রমশ কুটিল হয়ে ওঠে।
অফিস থেকে ট্যুরে যেতেই হয়। কখনো অসুবিধে থাকলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, বাড়িতে অসুস্থ সন্তানকে ফেলেই যেতে হয় এমন ট্যুরে, যা হয়ত না গেলেও চলত। এ কাহিনি শুধু আমার নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্য নারীদের অভিজ্ঞতাকে টুকরো টুকরো জুড়ে বানানো এক কাঁথার মত। যেমন, কাজ করতে করতে আমার সঙ্গেই কর্মরত কিন্তু অনেকটাই বয়সে ছোট এক মহিলার একটা গল্প শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। তার ক্ষেত্রে ঘটে যায় চূড়ান্ত ঘটনা। তার চাকরির জন্য ছোটাছুটির প্রয়োজন, অথচ সে অন্তঃসত্ত্বা। বসকে জানায়, এখন ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। বস শুনিয়ে দেন, কাজটা না হলে চলবে না। তারপর যতখুশি বিশ্রাম কর। তাকে দুদিনের মধ্যে দুবার প্লেনে চেপে এ শহর ও শহর করতে হয়। কিন্তু এর ফলে মেয়েটির শরীরে চাপ পড়ে এবং তার গর্ভপাত হয়ে যায়। সারাজীবন ঐ ভদ্রলোকটিকে ক্ষমা করতে পারেনি মেয়েটি। অত্যন্ত কর্মদক্ষ মহিলা। আমাকে যখন গল্পটি বলেন, কেঁদে ফেলেছিলেন। ঘটনা থেকে তখন তিনি দশ বছরের দূরত্বে। পরে আর একটি সন্তান এলেও, প্রথম অজাত সন্তানের জন্য বেদনা তখন তাঁর চোখে মুখে।
আমার কানে এই ঘটনাটি কোথায় যেন নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়েছিল। অথচ আমার তো কখনো গর্ভপাত ঘটেনি। কিন্তু অনুরূপ অন্য অভিজ্ঞতা কি আমার নেই? সবচেয়ে বড় কথা, এই বাধ্যতা, মানসিক অত্যাচার, নীরব অসহযোগিতা, এগুলো সবই আমার চেনা।
সবচেয়ে বড় যে কথাটা আমার মনে হয়েছে তা অন্য। মনে হয়েছে, আশ্চর্য, আমাদের কখনো জেন্ডার নিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয় না কেন? পুরুষদের ট্রেনিং দরকার সবচেয়ে বেশি, একজন মহিলার জীবনের নানা সময়ের যে অত্যন্ত জরুরি কাজগুলো সেগুলো সমাজের কাজ। সেগুলো সম্বন্ধে সংবেদন তৈরি করতে। মেয়েদের ট্রেনিংও জরুরি। কেননা, কীভাবে এই ধরনের সমস্যার সমাধান করা যায় তা আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়নি। উলটে, অন্য কারুর সঙ্গে এগুলো শেয়ার করার কথাও আমরা কোনদিন ভাবিনি। বলতে কি, আমার যা যা ঘটেছে, অন্যদেরও তাই ঘটে থাকবে, এটাই যেন ভাবিনি। ভেবেছি এগুলো একান্তভাবে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা একটা সামাজিক সমস্যা এবং এর সমাধান আমার বাইরে, অন্য কোথাও থাকতে পারে, এভাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত নেই। তাই বিভিন্ন সময়ে কাজে যোগ দেওয়া মেয়েদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ একই ধরণের হলেও তাদের মধ্যে সংযোগের কোন সূত্র নেই। হেল্পলাইন নেই শেয়ারিং নেই। তাদের কোনও ফোরাম নেই। যেখানে বয়স নির্বিশেষে এসে তাঁরা বলতে পারবেন নিজেদের সমস্যা।
এই প্রসঙ্গে বলি, আমার খুব রাগ হয় যখন গল্পে উপন্যাসে পড়ি, একটি মেয়ে চাকরি করতে গিয়ে কী কী কম্প্রোমাইজ করল তার কাহিনি ফেঁদে বসা হয়। উর্ধতন পুরুষ বসের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের চটুল বিবরণ আঁকা হয়। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা কতটা সুলভ জানি না, সরকারি ক্ষেত্রে একেবারেই সুলভ নয়। অন্তত কোনও পুরুষ উর্ধতনকে আমি যৌন ইঙ্গিতবাহী বা অন্য ধরণের আকর্ষণবাহী কিছুই আচরণ করতে দেখিনি। এবং যারা আমার আশেপাশে আছে তাঁদেরও দেখিনি। আসলে ভারতীয় ব্যুরোক্রেসির কতগুলো অলিখিত নিয়ম ও অদৃশ্য দেওয়াল আছে। একটা দেওয়াল হল, এই সার্ভিস ক্যাডারগুলি অত্যন্ত রক্ষণশীল, অত্যন্ত গভীরভাবে প্রথাসিদ্ধ কিছু আদবকায়দায় গাঁথা, যাকে বলি ডেকোরাম। এবং সর্বোপরি খুব নারীবিদ্বষী। অর্থাৎ সমস্যাটা উল্টোদিকের। নারীদের দূরে রাখো, এই নীতিতেই চলেছে আজও, ভারতীয় আমলাতন্ত্র। মেয়েদেরও হয়ে উঠতে হচ্ছে ‘পুরুষের মত’। যাকে, মজা করে কেউ কেউ বলে ব্লটিং পেপার। একজন কিরণ বেদি বা একজন লীনা চক্রবর্তী বিখ্যাত হন ‘পুরুষ’ দেরও হার মানিয়ে দিতে পারার ক্ষমতা দিয়েই।
প্রশাসনের চেয়েও আরো বেশি এই নারীবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছি জুডিশিয়ারি বা বিচারবিভাগীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রে। কোনও লোয়ার কোর্ট যখন চলে, সেখানে বিচারকরা তাঁদের চারিপাশে যে নিশ্ছিদ্র ডিসিপ্লিনের বলয় রক্ষা করেন, তা দেখার মত। এই সময়ে সেই কোর্টরুমে সামান্য কথাবার্তা বললেও তা ‘আদালত অবমাননা’ আর আপনি যদি মহিলা হন, এবং কালো কোট পরিহিতা না হন, তাহলে আপনার দিকে যে রোষদৃষ্টিতে তাকানো হবে তা রীতিমত ধাক্কা দেওয়া। একবার আমি অফিসের কোনও কেসের ব্যাপারে এমন এক কোর্টরুমে আমার সহকর্মীর সঙ্গে হেসে কথা বলছিলাম, এবং প্রায় রুলের গুঁতো খেয়েছিলাম। ওই মহিলা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন কেন? বেরিয়ে যেতে বলুন ওনাকে।
আদালতের যে ভয়ংকর হায়ারার্কি, তার একটা আবছা ছায়া এখনো বাকি প্রশাসনেও রয়ে গেছে। সম্পূর্ন উল্লম্ব এক প্রবল মান্যতার সিঁড়ি আছে। সাপসিঁড়ি খেলার চেয়েও যার ছোবল সাঙ্ঘাতিক।
এই এই করতে নেই, এই এই করতে হবে, এই নিয়মগুলো প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয়। বসেরা সচরাচর খুব কড়া, নিজেদের বস-ত্ব প্রমাণ করতে অসম্ভবরকম উদ্যোগী হয়ে অধস্তনদের উৎপীড়ন করে রাখেন সাগ্রহে। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে, ঘন্টার পর ঘন্টা ডিটেন করা অথবা আচমকা মেজাজ হারানো, ছুটি দিতে অস্বীকার করা, এসব করে তো থাকেনই, এমনকি মেমো, শো কজ, সাসপেনশন ইত্যাদিও পান থেকে চুন খসলেই হতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অধস্তনদের আমার জমিদারির প্রজা, অথবা ‘স্বতঃই গবেট’, ‘বেসিকালি ফাঁকিবাজ’ বলে ধরে নিতে পারি না বলেই, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকি। সেটা আমার কোন কৃতিত্ব নয়, বরং জেনেটিক কোডিং, এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আমার দুর্বলতা হিসেবেও পরিগণিত হয়, আমি জানি। বস হিসেবে আমার অধস্তনদের চোখে খুবই নরম সরম আমি। অন্তত নিচের দিক থেকে পাওয়া ফিডব্যাকে এরকমই জানতে পারি। মুখে তাঁরা বলেই থাকেন যে “ম্যাডাম আপনার মত বস পাব না” কিন্তু মাঝে মাঝে আমার মন বলে, হয়ত আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এঁদের আউটপুট বেড়ে যেত, ভয় এখনো ভারতীয় কর্মীবৃন্দের বড় চালক। ভয়ের জন্য ঠিক সময়ে অফিসে আসা থেকে শুরু করে আরো নানা ডিসিপ্লিন চলে।
এক্ষেত্রে একটা কথা অপ্রিয় হলেও বলে ফেলা ভালো। সে কথাটা বললেই আমি পলিটিকালি ইনকারেক্ট হয়ে পড়ব, এবং প্রাদেশিকতা বা পক্ষপাতিত্বের দায় এসে ঘাড়ে চাপবে। তবু, যেসব অসংবেদনশীল অফিসারদের সঙ্গে মহিলা অফিসারদের সমস্যাগুলো বেশি করে হয়, এবং যেসব অফিসাররা নিজের অধস্তনদের সঙ্গে সাংঘাতিক অসভ্যতা করেও, ভয়ের রাজত্ব নির্দ্বিধায় স্থাপন করে নিতে পারেন, তাঁরা বেশির ভাগই আসেন একটা বেল্ট থেকে, যাকে ভারতের কাউ বেল্ট বলা হয়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এইসব রাজ্য থেকে এখনও নারীবিদ্বেষ, জাতপাত এবং অন্যান্য সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগুলো যায়নি। যথেষ্ট জমিদারীসুলভ সামন্ততান্ত্রিক আদবকায়দার চল তাই এঁরা বহাল রেখেছেন কর্মক্ষেত্রেও।
কিন্তু এই সামন্ততন্ত্রে ক্ষমতাময়রা শুধু না, ক্ষমতাময়ীরাও কম যান না। আসলে ভূগোলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং এই প্রশ্নটা থেকেই এসে পড়ি আর এক অস্বস্তির জায়গায়। মেয়েদের সমস্যার কথা শুরু হলেই একদল পুরুষ বলেন, কেন, মেয়েরা নিজেরা কি ধোয়া তুলসীপাতা নাকি? তারা ঘুষ নেয় না? তারা অত্যাচার করেনা অক্ষমের ওপর?
হ্যাঁ, এঁরা ঠিক বলেন। আসলে, পুরুষ নারী এগুলি কোন নির্ধারক নয়। আসল নির্ধারক বোধ করি ক্ষমতা। পাওয়ার। যে ক্ষমতা পাবে, সে অক্ষমের ওপরে অত্যাচার করবে। এটাই সমস্যার জায়গা। সুতরাং একাধিক মহিলাও ক্ষমতার অলিন্দে নিজেকে পালটে ফেলেন, যে মুহূর্তে হাতে রাজদন্ড এসে পড়ে, তাঁদের রূপ বদলে যায়। এবং আগেকার প্রতিবাদী চরিত্র চলে গিয়ে এসে পড়ে একটা সংবেদনহীনতার মূর্তি।
এমনকি মেয়েদের ব্যাপারেও তখন তাঁদের কোন সংবেদন দেখা যায় না। ঠিক যেমন, বাংলা সিরিয়াল কাহিনিতে শাশুড়িরা বৌমাদের ওপরে অত্যাচার করার সময়ে, ভুলে যান তাঁদের বৌমা অবস্থার কথাগুলি, তেমনি, প্রশাসক যদি মহিলা হন, তাঁর অধস্তনের সমস্যাগুলোও তাঁর কাছে তখন আর লক্ষ্যনীয় থাকে না। তিনি তখন জাস্ট লাইক এনি আদার প্রশাসক। তিনি তখন ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি। সুতরাং।
(শেষ)
Link: https://ebongalap.org/story-of-a-working-woman-part-four