08-03-2024 17:27:44 pm
Link: https://ebongalap.org/teachers-day-special-blog-2
আছে এক কয়লাকুঠির দেশ। রানিগঞ্জ। সেই কবে ১৭৭৪ সনে কোলিয়ারি গড়ে উঠেছিল এখানে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত খনি ছিল এখানেই। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দামোদর। নদীর পাশেই সেই কবে গড়ে উঠেছিল তিরাট কোলিয়ারি। আর চেলোদ, হাড়াভাঙা, গরগরডাঙা, নিমধাওড়া, কেরকেনধাওড়া, কুমারডিহি ইত্যাদি গ্রামগুলি। বাইরে থেকে কোলিয়ারিতে কাজ করতে আসা কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া এই অঞ্চল মূলত বাউরি নামক দলিত সম্প্রদায়, মুচি, মেথর, রুইদাস এবং সাঁওতালদের বাস। কালো হীরেকে কেন্দ্র করেই এখানকার মানুষের স্বপ্নের দৌড়। বৈধ কোলিয়ারি ছাড়াও অবৈধ খাদান নিয়ত যোগান দিয়ে চলে অঢেল কালো টাকা। এছাড়াও ছড়িয়ে পড়ে থাকা কয়লা কুড়িয়ে আরো কত পেটের ভাতের সংস্থান হয়ে যায়। এখানে শুঁড়িখানা আর মহাজনি কারবার রমরমিয়ে চলে। নেশার টানে ঋণ করতে গিয়ে শেষে পে-স্লিপটাই জমা পড়ে যায় মহাজনের কাছে। সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। শেষপর্যন্ত পুরো বেতনই চলে যায় মহাজনের গর্ভে। শিক্ষাহীন শ্রমিক সরকারি কর্মী হয়েও দরিদ্রজীবন যাপন করে।
কন্যা সন্তানের জন্ম এখানে অবাঞ্ছিত। এই পরিবেশেই দাঁড়িয়ে আছে একচল্লিশ বছরের চেলোদ উচ্চ বিদ্যালয়। মিড-ডে মিল, সাইকেল, শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রীর টানে বিদ্যালয়ে ভিড় বাড়ছে। মূলত প্রথম প্রজন্ম, দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্ততিরাই এই বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। সামাজিক পরিবেশে কন্যারা অবহেলিত। সেই অনুভব প্রসারিত ছায়া ফেলছে বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয় সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। ললনারা বিদ্যালয়েও অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারে না। আপাত নিরাপদ গন্ডীর ভেতরেও কালো হাত কন্ঠরোধ করতে এগিয়ে আসে। ছাত্রী-শিক্ষিকা উভয়ের আপাত পরিচয় পৃথক হলেও মূলগত প্রভেদ নেই।
এইসব ম্লান মুখের অনাদৃতাদের সম্মন্ধে শ্রেণীকক্ষের দেওয়াল ভরে ওঠে অশ্লীল বাক্যে। সহপাঠী ছাত্রদের পৌরুষ প্রকাশের হাতেখড়ি। কুসুম, খুশি, নন্দনারা ক্যান্টিনে তেঁতুল চকলেট কিনতে গেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। ফাঁকা হয়ে গেলে ফাঁক বুঝে ক্যান্টিনের দাদু কুসুমকে ভেতরে ডেকে কোলে বসিয়ে আদর করে। অষ্টম শ্রেণির কুসুম ভাবে সম্পর্কে দাদু তো!! তাই হয়তো-------!!! তারপর একদিন শার্টের ভেতরে হাত ঢুকে যায়—দিশাহারা কুসুম অনেকদিন স্কুলে আসে না। তারপর একদিন স্কুলে এসে মায়ের পরামর্শে ক্লাস টিচারকে নালিশ জানায় । সেদিন জানলাম –এমন ঘটনা আরো অনেকের সাথেই ঘটেছে। নবম শ্রেণির অনিন্দিতা, রমা, সুলেখা বা ষষ্ঠ শ্রেণির পিঙ্কিও বাদ যায়নি। মেয়েরা অপমানে ভয়ে কেঁদেই একসা। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলি—ঘুরে দাঁড়াতে শিখতে হবে। ওঠার নামই বাঁচা।
ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষকদের মধ্যে আপৎকালীন বৈঠক বসে। ঠিক হয় ক্যান্টিন-চালককে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হবে। শিক্ষিকারা থানাতে অভিযোগ দায়ের করার পক্ষে থাকলেও পুরুষ সহকর্মীদের বাধাতে তা বাতিল হয়ে যায়। বলা হয়েছে অভিভাবকরা রাজি হবেন না। মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে -–জানাজানি হলে অসুবিধা। এক প্রত্যক্ষ পুরুষ থেকে আরেক অপ্রত্যক্ষ পুরুষের দিকে মেয়েদের এগিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠান স্বয়ং।
নারী পুরুষের ভোগের সামগ্রী। অতি কোমল কিশোরের অবচেতন সত্তাতেও এই বোধ চারিয়ে গেছে। ছাত্ররা তাদের সহপাঠীর মা-বোনকে ধর্ষণ করার হুমকি দিতে বাধে না। শ্রেণিকক্ষেই একদিন এরকম কথোপকথন শুনতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দিদিমণির পরিচয়ের বাইরে এই নারী-শরীর সেদিন প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল ।
ছাত্ররাও দিদিমণিকে টিজ করতে ছাড়ে না। বিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষিতে এভাবেই শিক্ষিকার আবেদনও বদলে যাচ্ছে। সন্তানতুল্য ছাত্ররা কোথা থেকে পাচ্ছে এই অনুভব? বিচার করতে বসে সর্ষের মধ্যেই ভূত দেখতে পাই। ওদের পরিবেশই কি এই বিষ রোপণ করে দিচ্ছে না? প্রথমত, নিরক্ষর দরিদ্রসমাজ উন্মুক্ত যৌনতা দেখতে অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে এক মাননীয় সাংসদ বিপরীত রাজনীতির মহিলাদের বাড়িতে ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। আবার কখনো যুদ্ধকে সমর্থন না করার কারণে সৈনিক কন্যা গুরমেহরকে হুমকি আর গুরমেহরকে সমর্থন করার কারণে মন্দাক্রান্তা সেনকেও ধর্ষণের হুমকি শুনতে হয়েছে এই সমাজের ফসল ছাত্রদের থেকে।
মেয়েদের লড়াইটা সব স্তরেই এক হয়ে যায়। মেয়েলি শব্দটাই যেন অভিশপ্ত। কোনো কোনো ছেলের মধ্যে যদি এই গুণ ছিটেফোঁটাও থাকে তাহলে আশেপাশে হাসির লহরী ছুটে যায়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র বিলু মারান্ডী। কোমর দুলিয়ে নাচলে আনন্দে সবাই হাততালি দিয়ে উঠি। নেহাত ছোট ছেলে। তাই এই মেয়েলিপনার নালিশ ওঠেনি এখনও।
এর বিপরীতে সীমাকে যখন দেখি!!! মনিটরের খাতায় ওর নাম থাকে সবার প্রথমে। মারামারিতে সে নাকি প্রথম। গাছে গাছে ঝুলে বেড়ানোটা তার প্রধান খেলা। ক্লাসের অন্য মেয়েরা আড়ালে তাকে মর্দা ডাকে। মিড-ডে মিলে রান্না করেন ওর মা। একদিন ডেকে ওঁর মেয়েকে একটু ‘মেয়েলি’ হবার জন্য বোঝাতে বলেন। ‘মেয়ে তো! বিয়ে দিতে হবে।আট কেলাস হয়ে গেল!’
‘মেয়ে’ শব্দটা এভাবে নানাভাবে ঘুরে ঘুরে আসে।
কন্যাশ্রীর কারণে অসময়ে বিয়ে কিছুটা থমকে থাকলেও প্রাপ্য টাকাটা বৃহত্তর পাঠে ব্যয় হয় না। বিয়ের যৌতুকের জন্য তোলা থাকে।
‘হা নারী তোমার এই জীবন বিদার অশৌচ
হা নারী তোমার কোন তৃপ্তি নেই জলের বিস্তারে
ফেলো শ্রুত-কীর্তি ইন্দ্র মণিহারা!’
--‘দুঃখ বড়ো কুড়াল’। কবিতা সিংহ।
এই ‘অশৌচ’ দূর করাটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ।
Link: https://ebongalap.org/teachers-day-special-blog-2