08-03-2024 12:32:53 pm
Link: https://ebongalap.org/toxic-masculinity-gender-in-school
প্রভিশনাল ক্লাস৷ সপ্তম শ্রেণীর বাংলা দ্রুতপঠন - ‘মাকু’। কিশোর উপন্যাস। লীলা মজুমদার। অন্য বিষয়ের শিক্ষক, হঠাৎ বাংলা ক্লাসে গিয়ে পড়েছি।
- গল্পটা বল দেখি, শুনি৷
- মাকু হল একটা রোবট আসলে। রাবার দিয়ে তৈরি। সব কাজ পারে। কিন্তু একটা জিনিস পারে না৷
- কী?
- কাঁদতে পারে না৷ কান্নার কল নেই মগজে।
সামনে সত্তরটি ছেলে, নরম-সরম। দুষ্টুমি আছে, সারল্যও আছে।
সামনে সত্তরজন আগামীর পুরুষ, যারা এতটাই দড়ো হয়ে উঠবে যে কাঁদতে ভুলে যাবে।
বয়ঃসন্ধির ছেলেদের খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয় প্রত্যেকদিন। অধুনা ‘টক্সিক মাসকুলিনিটি’ বা বিষাক্ত পৌরুষ বলে যাকে, তার সূচনার বয়সের আমি কর্মসূত্রে সাক্ষী। কেঁদে ফেলা পুরুষসুলভ নয়, অনুভূতিপ্রবণ বা আবেগসর্বস্ব হওয়া পুরুষসুলভ নয়, কিন্তু কর্তৃত্ব করা, দখল করা, গায়ের জোরে ছিনিয়ে নেওয়া পুরুষসুলভ - এইসব ধারণা ছোটবেলা থেকেই যেভাবে চারিয়ে যায় মগজে, তার সাক্ষী থাকি নিত্যদিন৷
ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ যাতে না থাকে তাই বলে রাখি, পুরুষ মাত্রই ‘বিষাক্ত’ - তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু হ্যাঁ, যে যে কার্যকলাপ সমাজের চোখে ‘ঠিকঠাক পুরুষ’ করে তোলে একজন ব্যক্তিকে, বা আদর্শ পৌরুষের যে সব নিদান পেতে পেতে একজন পুং-শিশু বড় হয়, তা অনেকাংশেই বিষাক্ত; ক্ষতিকর প্রথমত তার নিজের জন্য, দ্বিতীয়ত অন্যদের জন্যও।
টক্সিক মাসকুলিনিটি হল ‘পৌরুষ’-এর এমন এক সংকীর্ণ ধারণা, যা ‘পৌরুষ’-কে হিংসাত্মক কার্যাবলি, যৌনক্ষুধাসর্বস্বতা, আক্রমণাত্মক আচরণ, অনুভূতিশূন্যতা এবং (ধনতান্ত্রিক পরিকাঠামোয়) আর্থ-সামাজিক কৌলিন্য দিয়ে সূচিত করে। এ হল পুরুষত্বের এমন এক সাংস্কৃতিক ধারণা, যেখানে শক্তিপ্রদর্শন ও কর্তৃত্বই কেন্দ্রীয় ‘গুণ’। আবেগ, অনুভূতির যেকোনো প্রকাশ এই সংস্কৃতিতে পুরুষের ‘দুর্বলতা’ বা প্রকারান্তরে ‘মেয়েলি’। ‘হাইপারসেক্সুয়াল’ বা ‘অতিমাত্রায় যৌনভাবে সক্রিয়’ হওয়া এখানে স্বীকৃত, কিন্তু কনসেন্টের ধারণা স্বীকৃত নয়। টক্সিক মাসকুলিনিটিতে আক্রান্ত পুরুষ ‘মেয়েলি’ ও ‘হীনবীর্য’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে নিরন্তর ভোগে। এই ভয় তাদের দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারে। সে অন্যের উপর শারীরিক আক্রমণ করতে পারে, আক্রমণাত্মক কথা বলে অন্যদের অতিষ্ঠ ক’রে তুলতে পারে, যৌন নির্যাতনও করতে পারে৷ সবের মূলেই থাকে ‘নারী’ বা ‘সম্পত্তি’ বা ‘ভূখণ্ড’-এর কর্তৃত্ব না হারানোর, কোনো যুদ্ধেই না হারার ‘পুরুষোচিত’ জেদ৷
আবার কোনো পুরুষ বা বালক হয়ত আদৌ আক্রমণাত্মক নয়৷ অত্যাচারীও নয়৷ টক্সিক মাসকুলিনিটি তাকেও প্রভাবিত করতে পারে৷ কীভাবে? ধরা যাক এক কিশোর (এমনকী পূর্ণবয়স্ক পুরুষও হতে পারে) যৌন নির্যাতনের শিকার৷ কিন্তু সে যখন নিজের উপর ঘটা অত্যাচারের কথা বলতে চাইছে, বাধ সাধছে সেই ভয় - আমাকে কেউ কম ‘পুরুষ’ ভাববে না তো?
যে ছেলেটি সায়েন্স পড়তে বাধ্য হল সাহিত্য ‘মেয়েলি’ বিষয় বলে, যে কোমলমতি ছেলেটির খিস্তি না দিলে বন্ধুমহলে মান থাকে না, একটি বাচ্চা ছেলে বলেছিল ভিড়ের মধ্যে বন্ধুরা জোর করে তার একটি হাত দিয়ে কোনও এক মেয়ের বুক ছুঁইয়ে দিয়েছিল - এরা প্রত্যেকে পিতৃতন্ত্রের নির্মম শিকার। এদের দেখতে পাই নিজের স্কুলে, অন্য স্কুলে, সর্বত্র৷ বছর দুই আগে দিল্লিতে প্রদ্যুম্ন বলে বাচ্চা ছেলেটিকে যে কিশোর মারল, সেই কিশোরের কী এমন মানসিক বিকার ছিল? এত কম বয়সে সেই বিকার এল কোথা থেকে? কিংবা ভিন্নধর্মী মেয়ে আসিফাকে ধর্ষণ করেছে যে কিশোর? ভিনধর্মীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে যে কিশোরেরা? নির্ভয়া কাণ্ডে চোদ্দ বছরের সেই ধর্ষকের বিকারকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব, যে বলেছিল যোনিতে রড ঢোকানোর প্ল্যান তারই ছিল? এরা সকলেই কি কম বয়সে টক্সিক মাসকুলিনিটির শিকার নয়?
সুতরাং, টক্সিক মাসকুলিনিটি নিয়ে কোনো আলোচনার উদ্দেশ্য পুরুষ-নিন্দা নয়৷ পুরুষকে বিষাক্ত অপরাধী ঠাওরানো নয়৷ বরং তা গঠনমূলক পৌরুষের ধারণা গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হতে পারে৷
একটি পূর্ণাঙ্গ বালক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হই সাড়ে দশ বছর আগে। ঘটনাচক্রে আমি সেই বিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা শিক্ষক। সেসময়ে লেডিজ টয়লেটহীন স্কুলটিতে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত সকলেই আমাকে ‘স্যার’ বলে ডেকে ফেলত ভুল করে।
ক্রমে লেডিজ টয়লেটের ব্যবস্থা হল। ছাত্রদের টয়লেটও ভোল পাল্টাতে লাগল৷ সেখানে শিক্ষিকাদের(ইতোমধ্যে আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন) নামে দেখা যেতে লাগল বিচিত্র গ্রাফিতি। ফোর্থ ক্লাস দাদা গেলেন চুনকাম করতে। স্টাফরুমে সহশিক্ষক বললেন, শিক্ষিকাদের ‘সম্ভ্রম’ রক্ষা করা হল দেওয়াল চুনকাম ক’রে। বললাম, ‘সম্ভ্রম’ যায়-টায়নি৷ ব্যর্থতা স্কুলের ডিসিপ্লিনের। বললাম, লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা জিইয়ে রেখে সুশীল বালক তৈরি করতে গেলে চোরাগোপ্তা এমন হতেই পারে।
আজ থেকে এগারো বছর আগে স্কুলে আইন করে মারধোর নিষিদ্ধ হয়ে যায় নি। যে যে পুরুষ শিক্ষকরা বেধড়ক মারতেন(এমন নয় যে তাঁরা ভালোবাসতেন না, কিন্তু মারতেনও), তাঁদের বেশ নায়কোচিত সম্মান ছিল ক্লাসে৷ স্যার কীভাবে এক মারে চুপ করিয়ে দ্যান, কীভাবে মারের আগে ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখেন, কীভাবে কলার ধরে শূন্যে তুলেছিলেন একদিন, এগুলো বেশ সপ্রশংসভাবে আলোচিত হত ছাত্রদের মধ্যে। কিশোর-চোখে ভায়োলেন্স হয়ে উঠত ‘পুরুষোচিত ব্যাপার’৷ মহিলা শিক্ষকের থেকে ছাত্রদের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন। মমতা, প্রশ্রয় এবং যা কিছু ‘মায়ের মতো ভালো’৷
ক্রমশ ছাত্রদের সঙ্গে নানা বিষয়ে যত বেশি কথা হতে লাগল, ততই তাদের বেড়ে ওঠার নানা দিক ভাবিয়ে তুলল। যেমন, কম বয়সী ছেলেদের খিস্তি-শাস্ত্রে দীক্ষার ব্যাপারটি বিশেষ ভাবে আগ্রহী করল। খিস্তির ভাণ্ডারে কী থাকে? দু-অক্ষর মাত্র নয়, চার-অক্ষরও। ‘তোর মাকে’ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকিও থাকে। না, এই স্কুলে শিক্ষকদের সামনে এসব কথা বলার চল নেই৷ মাঝে মধ্যে, বিশেষত নিচু ক্লাসে, অপরাধীর বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতায় এইসব প্রকাশ্যে এসে পড়ে৷ আড়ালে-আবডালে রগরগে খিস্তি না মারলে ঝাঁঝ মেশে না সদ্যপ্রস্ফুটিত পৌরুষে।
প্রথমেই যে প্রশ্নটি অবধারিত ভাবে করি, তা হল- ‘কোত্থেকে শিখলি?’ এবং অবধারিত ভাবে যে উত্তরটি পাওয়া যায়, তা হল- ‘দাদাদের থেকে।’ কে দাদা? ক্লাস ফাইভের দাদা সিক্স-সেভেন, সেভেনের দাদা এইট, এইটের দাদা নবম-দশম, তাদেরও দাদা একাদশ-দ্বাদশ। এছাড়া আছে তুতো দাদা, পাড়াতুতো দাদা, খেলার মাঠের দাদা, টিউশনের দাদা৷ ‘পুরুষ’ হওয়ার পাঠ এইভাবে পুরুষানুক্রমে চলে। বাচিক ও শারীরিক ভায়োলেন্সে দক্ষতা প্রদর্শন যে পুরুষ হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ, তা এই দাদারাও শিখেছে তাদের দাদাদের থেকে।
কিছু ছেলে আছে, যারা এফেমিনেট, মেয়েলি। চলন-বলন খানিক আলাদা৷ পড়াশোনায় বিরাট কিছু ভালো না হলে, বা অন্য কোনো গুণের কারণে স্কুলে বিশেষ মর্যাদা না থাকলে, এদের টিটকিরি জুটেই থাকে। এদের হাঁটা বা কথা বলার ধরন নকল করা হয় দৈনন্দিন৷ শুনেছি কলেজে পড়তে গেলে যখন আরও হ্যাটা হতে হয়, তখন স্কুলের সহপাঠীরাই আবার(এক কলেজে থাকলে) ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পুরোনো বন্ধুর সামনে৷ কিন্তু নিজেদের মধ্যে মেয়েলি বন্ধুদের নিয়ে হাসি মস্করায় এরা দোষ দেখে না৷ অনেক সময় নারীসুলভ ছেলেটি নিজেও এতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, প্রতিবাদ করে না, হাসে।
‘নাচ জানা’ ছেলেদের নিয়ে হাসাহাসিও আছে। একটি সাধারণ বাংলা মাধ্যম বয়েজ স্কুলে হাজার জনের মধ্যে মেরে-কেটে পাঁচজন নৃত্যশিল্পী পাওয়া যায়৷ মফস্বলি ছেলেদের নাচে আগ্রহ থাকলেও সেই আগ্রহকে অচিরেই পাথর চাপা দিতে হয়৷ কিংবা একটু ঘুরিয়ে দিতে হয় আগ্রহের অভিমুখ। যেমন, অষ্টম শ্রেণির এক ছেলে, কত্থক নাচত মূলত। একদিন জানলাম, ছেড়ে দিয়েছে৷
- ছেড়ে দিলি?
- ছাড়িনি। কিন্তু কত্থক আর করছি না।
- তাহলে?
- ওয়েস্টার্ন, হিপ-হপ।
- কত্থক ছেড়ে তবে এগুলো ধরতে হল?
- বাড়িতে বলল। বলল, ইণ্ডিয়ান ক্লাসিকাল নাচলে মেয়েলি হয়ে যায়। হিপ-হপ, ওয়েস্টার্ন এসব বরং ছেলেদের মানায়৷ টিভিতে রিয়ালিটি শো’য়ে ছেলেরা তো এসবই নাচে।
তারপর ধরা যাক, মাথা ফাটিয়ে টিচার্স রুমে এসেছে একটি ছেলে। রক্ত বেরোচ্ছে। কাঁদছে। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে৷ যত্নও করা হচ্ছে৷ হাসপাতালে নিয়ে যাবেন কোনো না কোনো শিক্ষক। কর্তব্যে কোনো অবহেলা নেই৷ কিন্তু তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে - ‘পুরুষমানুষ ব্যথা পেলে কাঁদে না।’
আবার হয়ত, উঁচু ক্লাসের কোনো ছেলে একতরফা কোনো প্রেমে দাগা খেয়েছে৷ হতাশায় ভুগছে৷ ছাত্রবৎসল কোনো শিক্ষক হয়ত জানতে পেরেছেন, তাই সান্ত্বনা দিচ্ছেন৷ সান্ত্বনার ভাষা হতেই পারে এরকম- ‘এরকম মেয়ে-টেয়ে ভবিষ্যতেও ভুরি ভুরি পাবি৷ অত ভেঙে পড়ার কিছু নেই।’ অথচ আসলে যা করা উচিত ছিল, তা হল, এই সুযোগে ‘কনসেন্ট’-এর ধারণা ভালো মতো খোলসা করে বোঝানো। একটি সম্পর্ক গড়ে উঠতে গেলে যে দুজনেরই সম্পূর্ণ সম্মতি দরকার এবং সম্মতি যে গায়ের জোরে বা কেঁদেকেটে আদায় করার জিনিস নয়, তা বোঝানোর সুবর্ণ সুযোগ হতে পারত এরকম পরিস্থিতি৷ পরিবর্তে শেখানো হল - ‘না’ বলতে পারে, এমন মুখর মেয়েদের হেয় করাই যায়।
জেলার বাংলা মাধ্যম বয়েজ স্কুলের শিক্ষিকা বোঝে, এহেন নিয়মিত সামাজিক মস্তিষ্কপ্রক্ষালনের মোকাবিলা করতে দরকার সুনির্দিষ্ট, সুসংহত বিপরীত ইন্ডক্ট্রিনেশন, কিন্তু পাঠ্যক্রমের মধ্যেই জেণ্ডার রাজনীতির প্রাথমিক পাঠের ব্যবস্থা না থাকলে তা দুঃসাধ্য। শিক্ষিকা, অতএব, ঢাল-তলোয়ার হীন নিধিরাম সর্দার৷ খাপছাড়া চেষ্টা তাও চলতে থাকে, যতই অপ্রতুল হোক। কীরকম সেসব চেষ্টা? সে কথা না হয় পরের কিস্তিতে।
Link: https://ebongalap.org/toxic-masculinity-gender-in-school