12-02-2024 18:27:52 pm
Link: https://ebongalap.org/transgender-lit-meet-india
“একটি জন্মগত ভুল শরীর, ভুল পরিচয়
আর দেহ-মনের ভিন্নতা
যাদের ছবি নিয়ত আঁকা অবজ্ঞা বদনামে
যদিও প্রথম বা দ্বিতীয় নয়, ওদের স্থান তৃতীয়
তবুও শঙ্খ বাজে অদ্বিতীয় অদ্বিতীয়।”
-দেবদত্তা বিশ্বাস
কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এক অভিনব সাহিত্য সম্মেলন। ভারত সরকার পরিচালিত সাহিত্য আকাদেমি-র আয়োজনে গত ১৭ জুলাই ২০১৮ শহর কলকাতার বুকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ কবি সম্মেলন’ উদযাপিত হল। রূপান্তরের মানুষদের যখন মূলস্রোতে থাকা বা না থাকা নিয়ে বিস্তর জল্পনা-জলঘোলা, তখন সাহিত্য আকাদেমির এই আয়োজন স্ফুলিঙ্গের মতো।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে এমন উদ্যোগ এর আগে কখনও হয়নি শহরে। সাত রূপান্তরী কবিকন্ঠে পরিপূর্ণ সভাঘর, ছোট-বড় সংবাদ মাধ্যম আর জীবনে পাওয়া না পাওয়ার গল্প নিয়ে রচিত হল ইতিহাস। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপী এই সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন বহু কবি সাহিত্যিকরা। এইদিনের সম্মেলনে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ ছিল আমারও। আমার সঙ্গে কবিতা পাঠ করলেন দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, রানি মজুমদার, শংকরী মন্ডল নস্কর, অরুণা নাথ, প্রস্ফুটিতা সুগন্ধা এবং মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনুষ্ঠানটির মনোগ্রাহী পরিচালনা করেন কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ এবং 'বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার ডেভলপমেণ্ট বোর্ড' এর ভাইস চেয়ার পার্সন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি তিনি সাহিত্য আকাদেমি-র বাংলা উপদেষ্টা পর্ষদের একজন সদস্যও। প্রায় কুড়ি বছর ঝাড়গ্রামের এক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। যখন বাংলায় এমনকী ভারতেও সেভাবে কেউ লিঙ্গান্তরের কথা ভাবে না, সেই সময়ে মানবী-র নারীত্বে রূপান্তর। রূপান্তর কামনা সমাজে তখন ঘৃণ্য পাপ। সেই সময়ে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করে নারীত্ব অর্জন করেছেন মানবী। কিন্তু যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। কবিতা-সন্ধ্যায় বারবার সেই লড়াইয়ের ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর ভাষায়, কাব্যে। তাঁর প্রতিটা বাক্যে কখনো শ্লেষ, কখনো বা কড়ি-কোমল রাগ ছুঁয়ে যাওয়া। বহু রূপান্তরকামী-র রোল মডেল, কারও মা কারও দিদি কারও ম্যাডাম মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে এক মঞ্চে বসার অভিজ্ঞতাটা অবর্ণনীয়।
অনুষ্ঠানে ছিলেন কবি দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। কলকাতার এক কলেজে ফিজিওলজির অধ্যাপক দেবজ্যোতি। কবিতার প্রতি ভালোবাসা ছোট থেকেই। মেল-টু-ফিমেল ট্রান্সজেন্ডার দেবজ্যোতির নারীজীবনও জন্মসূত্রে পাওয়া নয়। তাঁকে তাঁর নারীত্ব অর্জন করতে হয়েছে। সমাজে লড়তে হয়েছে প্রতিনিয়ত। তাঁর কণ্ঠে ‘অসুখ’ কবিতাটি তাই বড় প্রাসঙ্গিক-
“ নারী মনে পুরুষ শরীর, এটা কেমনে হয়?
শরীর-মন না মিললে তো মনেরই অ-সুখ হয়।”
রূপান্তরকামী নারী বা পুরুষদের পরিবার যে তাদের এই কামনাকে সহজভাবে সবসময় মেনে নেয় তা নয়। বিরোধ বিবাদে রূপান্তরিত নারীর জীবন এলোমেলো হয়ে যাওয়ার গল্পটা সবার ক্ষেত্রেই বোধহয় একই রকম। দেবজ্যোতি-র কবিতায় সেই সুরেরই অনুরণন –
“আগে যখন চাঁদনি রাতে, দাওয়ায় তোমার কোলে শুয়ে
ঘুম পাড়াতে ঘুমের দেশের ছড়া কেটে কেটে
তখন তো দাওনি কখনও এভাবে দূরে ঠেলে
যেদিন বললাম
মাগো আমি তোমার খোকন নই যে
আমি তোমার খুকি
সেদিন হতে তুমি আমায় পর করলে বড়।”
রূপান্তরকামী জীবনের যাপনকথার কাব্য সৃষ্টি করেন রাণিগঞ্জ নিবাসী রানি মজুমদার। তাঁর সম্পাদিত ‘অন্য নারীর অন্য কথা’ এক নির্মম জীবনের গল্পই বলে। এই জনপ্রিয় পত্রিকাটির লেখক তালিকায় যেমন রয়েছেন রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ তেমনই মহাশ্বেতা দেবী, নবনীতা দেবসেন এর মতো মুক্তচিন্তার কান্ডারী বহু মানুষের সৃষ্টি, তাঁদের গল্পও জায়গা করে নিয়েছে এখানে। বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে রানি-র বিদগ্ধ বিশ্লেষণ এই কবিসম্মেলনে অন্য মাত্রা এনে দেয়। আর এই অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসঙ্গেই আসে কবি শঙ্করী মন্ডল নস্কর-এর কথা। বিবাহিত এই রূপান্তরিত নারী কিছুদিন আগে সন্তান দত্তক নেন। তাঁর দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ প্রান্তিকতার বেড়া ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ-বিপ্লবের পথ দেখায় নিঃসন্দেহে।
‘মধ্যবাংলার সংগ্রাম সমিতি’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কান্ডারী বহরমপুরের অরুণা নাথ এদিনের অপর গুরুত্বপূর্ণ নাম। সদ্য মাতৃহারা কবি প্রথমেই মায়ের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানান সম্মেলনের মঞ্চে। এক রূপান্তরকামীর জীবনে মায়ের ভূমিকা যে কতটা সেকথাও বলেন অরুণা। তাঁর কাব্যেও আমরা পেলাম সেই গভীর অনুভূতির ছোঁয়াচ।
যাঁর কথা না বললে হয়ত এই তৃতীয় লিঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পুরোটা বলাই হবে না, তিনি প্রস্ফুটিতা সুগন্ধা। মেদিনীপুরের এক গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেন প্রস্ফুটিতা। তাঁর এই নামটি মানবীদির দেওয়া। প্রত্যন্ত গ্রামের এই রূপান্তরকামী নারীর সদ্য-নারীত্ব যেন কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার মতো। আবার পুরুষের শরীরে নারীমনের মান্যতা পাওয়া যেন ফুল হয়ে ওঠার মতোই। গ্রামের পথের ধারে সদ্য ফোটা ফুল প্রস্ফুটিতা সুগন্ধাকে এই সম্মেলন এনে দিয়েছে ফুটে ওঠার এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। তাঁর সহজ সরল উচ্চারণ মনে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল।
রূপান্তরকামীদের কথা বলতে গিয়ে সমাজ যে ‘হিজড়া’দের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে, তাঁরাও লিঙ্গগত পরিচয়ের দিক থেকে সমাজে ব্রাত্যই। এদিনের সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলেন হিজড়া পেশায় থাকা কিছু মানুষ। নবজাতকের আগমনে হিজড়া নাচের বায়না তাঁদের পেশাগত পরিচয়, লিঙ্গগত পরিচয় নয়। তবু এই পেশার কারণেই তাঁরা মুখে মুখে গান বাঁধেন, সৃষ্টি করেন জীবন-অনুভূতিময় কাব্যের। তাঁদের সেই সৃষ্টির স্বাদও ভাগ করে নেন উপস্থিত সকলে, মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে হিজড়া গান পরিবেশিত হয় সম্মেলনের মঞ্চে। সমাজের বঞ্চনার পাশাপাশি অন্ত্যজ ব্রাত্য লিঙ্গের মানুষের বেদনা আর অনুভব উঠে আসে তাঁদের গানের কথায়।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত কবি সুবোধ সরকারের কথায়, দলিতদের ভাষায় দলিত-বঞ্চনার কাহিনী যেমন দলিত সাহিত্যের মত একটি ভিন্নতর সাহিত্যধারা সৃষ্টি করেছে, তেমনই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাহিনী যদি তাঁরা নিজেরাই উচ্চারণ করেন তবে তা হবে দৃষ্টান্তমূলক। এভাবেই সাহিত্য আন্দোলনের একটি ধারা হয়ে উঠবে তৃতীয় লিঙ্গ সাহিত্য। সাহিত্য আকাদেমির আধিকারিক ডক্টর সাহু এই অনুষ্ঠানের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতার কথা উল্লেখ করেন। সমাজের রক্ষণশীল ও ভ্রান্ত ধারণা মুছে ফেলে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গ উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে এই উৎসাহী পদক্ষেপ তৃতীয় লিঙ্গ সাহিত্যচর্চার এক সদর্থক দিকের ইঙ্গিত নিঃসন্দেহে।
Link: https://ebongalap.org/transgender-lit-meet-india