24-02-2024 08:17:46 am
Link: https://ebongalap.org/violence-and-hate-crimes-in-india
৭০ বছর। বয়স বাড়ছে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের। আর সেই সঙ্গেই বাড়ছে ধর্ম আর ‘দেশভক্তি’-র নামে লাগাতার হিংসা ও হত্যালীলা। ২০১৮-র ২৬ জানুয়ারি, ‘এখন আলাপ’-এর পাতায় ২০১৪-২০১৭ এই তিন বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘটে যাওয়া হিংসা ও হত্যার নৃশংস ঘটনার তালিকা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ধর্মান্ধতা ও হিংসার দিনলিপি ২০১৪-২০১৭’। এরপর, আমরা পেরিয়ে এলাম আরও একটা বছর। হিংসার রোজনামচা বেড়েছে বই কমেনি। গত এক বছরের সেরকম কয়েকটা কালো দিন এবারের দিনলিপিতে।
ছোট্ট মেয়েটির ‘অপরাধ’ সে যাযাবর মুসলমান গোষ্ঠীর একজন। ‘বকরওয়াল’ গোষ্ঠীকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে ৮ বছরের শিশু আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যা করল একদল যুবক। কাশ্মীরের কাঠুয়ার এই ঘটনায় ঐ নাবালিকাকে ৪ দিন আটকে রেখে লাগাতার তার সাথে গণধর্ষণ চালায় এলাকার হিন্দু পুরোহিত সঞ্জি রাম ও তার পরিবার এবং সাঙ্গপাঙ্গরা। অবশেষে গলা টিপে খুন করা হয় তাকে।
পুকুরপাড়ে রোজকার কাজ সারছিলেন শাহজাহান। পিছন থেকে লোহার রড পড়ল মাথায়। রামনবমীর শোভাযাত্রা ঢুকে পড়েছিল অন্য রাস্তায়, তাকে পথে ফেরাতে নেমে পড়ে স্থানীয় লোকজন এবং পুলিশ। শোভাযাত্রার এক ব্যক্তির বাইক পোড়ানো হলে তার থেকে গন্ডগোল শুরু হয়। হাতাহাতি, ভাঙচুরের পাশাপাশি ৫০ বছরের শাহজাহানকে খুন করা হয় নৃশংসভাবে, কয়েকজন পুলিশকর্মীও গুরুতর আহত হন।
রামনবমী-র মিছিল ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের রাণিগঞ্জ-আসানসোলে ২৭ মার্চ ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। তারই জেরে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারা হল ১৬ বছরের শিবতুল্লা রাশিদিকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শিবতুল্লার বাবা স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তাঁর কথায়, ছেলের হত্যাকারীকে তিনি দেখেননি, তাই এই হত্যার প্রতিশোধের নাম করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা আরও ছড়িয়ে পড়তে দেবেন না তিনি। ২৭ মার্চ দাঙ্গার পরের দিন রাতে নিখোঁজ শিবতুল্লার দেহ পাওয়া যায়।
হনুমান জয়ন্তীর মিছিল মসজিদ পেরোচ্ছিল রাজস্থানের পালি এলাকায়। মিছিল থেকে উড়ে আসা টুকরো মন্তব্যের জেরে একদল মুসলিম পাথর ছুঁড়তে থাকে মিছিল লক্ষ্য করে। এর পরেই মিছিলের উন্মাদনা ভয়ানক সংঘর্ষের রূপ নেয়। ২৫ টির বেশি দোকান, আধডজন গাড়ি, পাবলিক বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষের মুখে নাস্তানাবুদ হন স্থানীয় মানুষ। সরকারি বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিও প্রচুর।
শবযাত্রা কোন রাস্তা দিয়ে যাবে সেই নিয়ে বিতর্কের জেরে দলিত ও মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে অশান্তি তুমুলে ওঠে তামিলনাড়ুর থেনি এলাকায়। হাঙ্গামায় আহত প্রায় ৩০, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ৩ টি গাড়ি, সংলগ্ন ২টি দোকানঘর এবং বিভিন্ন গৃহস্থালির জিনিসপত্র। আহতদের জয়মঙ্গলম ও পেরিয়াকুলাম হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
জামাল মোমিন, পেশায় দিনমজুর এবং ধর্মে মুসলমান। আর সেটা জেনেই ট্রেনের সহযাত্রী চার যুবক মোমিনকে হেনস্থা করে চলন্ত ট্রেনেই। হুগলির এই ঘটনায় অভিযোগ মোমিনকে ঐ যুবকরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিতে না পারায় এই হেনস্থা।
ওদের হাতে ছিল কুঠার, তরোয়াল আর লাঠিসোটা। ইফতারের সময় নাগাদ জোর করে ওরা ঢুকে পড়ে ঘরের ভিতর। ঝাড়খন্ডের কোডারমায় প্রায় ২০ টি মুসলিম পরিবার তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন, যখন একদল উন্মত্ত জনতা সরাসরি বাড়ির ভেতরে ঢুকে হেনস্থা শুরু করে। মহিলাদেরও রেহাই দেয়নি তারা। এমনকি মসজিদে ঢুকে মাগরিবে প্রার্থনারত লোকেদের ওপরেও অত্যাচার চালায় তারা। লন্ডভন্ড করে দেয় ঘরের জিনিসপত্র ও মসজিদের যাবতীয় জিনিসপত্র।
নামাজের পর মসজিদ থেকে গ্রামে ফিরছিলেন ওঁরা। রাস্তায় পাশে এসে দাঁড়ায় একটি এসইউভি। ২০ জন ছিলেন সেই গাড়িতে। তাদের দাবী ‘জয় শ্রী রাম’ বলে জয়ধ্বনি দিতে হবে। অস্বীকার করায় লাঠি এবং হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে আরম্ভ করেন এসইউভি আরোহীরা। একজন পালিয়ে বাঁচলেও অন্য আক্রান্ত গুরুতর জখম হন।
স্থানীয় হাট থেকে বেচাকেনা সেরে ফিরছিলেন তিনজন। একজন পশু ব্যবসায়ী, অন্য দু’জন তাঁর আত্মীয় এবং গাড়ির ড্রাইভার। আরএসএস-এর গুন্ডারা চড়াও হয় তাঁদের ওপর। আক্রান্তদের মতে অনেকক্ষণ ধরেই বাইকে ফলো করা হচ্ছিল তাঁদের। রাস্তায় একজায়গায় দাঁড়াতেই গুণ্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের ওপর। গুরুতর আহত হন তাঁরা। অভিযুক্তদের বক্তব্য এই তিনজন নাকি তাদের মুখে গরুর গোবর ছুঁড়ে মেরেছিল, তার জেরেই এই ঘটনা। যদিও এই ঘটনা অস্বীকার করেছেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
মুসলমান হয়ে গরু রক্ষণাবেক্ষনের কাজ করায় এসিড ছোঁড়া ও খুনের হুমকি ভোপালের এক মহিলাকে। অভিযোগকারিনীর বয়ান অনুযায়ী, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এবং এলাকার কিছু মানুষ অনেকদিন ধরেই শারীরিক মানসিক অত্যাচার চালাচ্ছে তার গোয়াল চালানোর কাজ এবং তিন তালাকের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। সুবিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন মহিলা। এর মধ্যে হোয়াটসএপে কাটা মুন্ড ও এরকম আরো কিছু নৃশংস ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে তাঁকে ভয় দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ।
‘স্বাধীনতা দিবসের উপহার’ বন্দুকের গুলি। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির ছাত্রনেতা উমর খালিদকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হল। দিল্লির কন্সটিটিউশন ক্লাব অব ইন্ডিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার কথা ছিল খালিদের। ক্লাবের সামনেই খালিদকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় একদল লোক। খালিদ নিজেকে বাঁচিয়ে বেরিয়ে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্দুকবাজেরা ভিডিও পোস্ট করে ঘোষণা করেন, যে এই কাজ তাদেরই, এবং ‘দেশের জন্য’ এটা ছিল তাদের স্বাধীনতা দিবসের উপহার।
গরু চুরি করেছেন এই সন্দেহে আসামের বিশ্বনাথ জেলার সুতিয়া এলাকায় আদিবাসী গোষ্ঠীর পঞ্চাশোর্ধ্ব দেবেন রাজবংশী এবং তাঁর আরও দুই সঙ্গীকে এলাকার উন্মত্ত জনতা মারতে শুরু করে। জনতার মারে প্রাণ হারান দেবেন, তাঁর দুই সঙ্গীকে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের নেকপুরে ‘গোরক্ষক’ বাহিনীর হাতে পড়েছিলেন ভুরে। বেআইনিভাবে গোমাংস পাচারের অভিযোগে তাঁকে হেনস্থার পর নিগোহি থানায় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর থেকে পাওয়া গেছিল গোমাংসের প্যাকেট। যদিও বেআইনি মাংস পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভুরে ও তাঁর পরিবার। ঘটনার আইনি তদন্ত হওয়ার আগেই, নিগোহি থানার দুই কর্মী সমস্ত গ্রামবাসীর সামনে ভুরেকে বাধ্য করেন মুখে করে সেই কাঁচা গোমাংস তুলে আবার প্যাকেটে রাখতে। ঘটনাটির ভিডিও পোস্ট হওয়ার পর বরখাস্ত হন ওই দুই পুলিশকর্মী।
অন্য সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে গুরুদ্বারের সামনে রাখি বিক্রি করছিল। এতেই ঘোর আপত্তি তুলে বান্দা চৌরাহা গুরুদ্বারের সেবাদর হেনস্থা করলেন নাবালিকাকে। তার জেরেই প্রথমে কথা কাটাকাটি এবং তারপরে ক্রমশ হাতাহাতি ভাঙচুর শুরু হয় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। অশান্তি ক্রমে দাঙ্গার চেহারা নেয়। শূণ্যে গুলি ছোঁড়া, যানবাহনে আগুন ধরানো ইত্যাদির জেরে দু’জন পুলিশকর্মীসহ ১২ জনের বেশি আহত। এই ঘটনায় ৩০০ জনের বেশী গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বছর চব্বিশের যুবক পেরুমাল্লা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ২০ বছরের অম্রুথা বর্ষিনিকে। আর সেটাই তার অপরাধ। কারণ দলিত খ্রীষ্টান পেরুমাল্লা-র স্ত্রী নালগোন্দা-র প্রভাবশালী উচ্চবংশীয় হিন্দু মারুথি রাও এর কন্যা। একজন দলিত খ্রীষ্টান হয়ে উঁচুজাতের মেয়েকে ভালোবাসার স্পর্ধা সহ্য হয়নি রাও এর। আর তাই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কুপিয়ে খুন করা হল প্রণয়কে।
মীরাটে এক মুসলিম যুবকের বাড়িতে হানা দিয়ে ‘লাভ জিহাদ’-এর তকমা লাগিয়ে যুবক আর তার হিন্দু বান্ধবীকে পেটাল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা। শারীরিক নির্যাতনের পর তাদের দুজনকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় থানায়। পরে সামনে আসা একটি ভিডিও থেকে জানা যায় থানায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে পুলিশ ভ্যানে নির্যাতনের শিকার হয় মেয়েটি। তদন্ত চলাকালীন চারজন পুলিশকর্মী বরখাস্ত রয়েছেন।
মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ জয়নুল আনসারি। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগেই পড়ে গেলেন উন্মত্ত জনতার রোষের মুখে। বিহারের সিতামারিতে দুর্গাপুজার ভাসানের শোভাযাত্রা একটি বিশেষ জায়গা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে উন্তত্ত জনতা জীবন্ত পুড়িয়ে দিল বৃদ্ধের শরীর। ঘটনার দু’দিন পরে আনসারি-র নিখোঁজ রিপোর্টের ভিত্তিতে বোঝা যায় পুড়ে যাওয়া শবদেহটি আনসারি-র।
চার-পাঁচজন বন্দুকধারী ‘অজানা’ ব্যক্তি জোর করে পাড়া থেকে তুলে নিয়ে যায় ৭ যুবককে। অসমের তিনসুকিয়ার বাসিন্দা এই সাতজনই হিন্দু, বাঙালি এবং পেশায় কৃষক। এদের জোর করে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে সন্ধের মুখে পরপর গুলি করা হয় প্রত্যেককেই। পয়েণ্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সরাসরি গুলির আঘাতে তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারান ৫ জন। বাকি ২ জনকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্দেহ ইউএলএফএ(ইণ্ডিপেণ্ডেণ্ট)-এর মদতেই এই নৃশংস হত্যাকান্ড।
মাঝরাতে লাঠি দেখিয়ে ট্রাক থামালেন ৪-৫ জন লোক। নিজেদের পরিচয় দিলেন ‘গোরক্ষক’ হিসেবে। ঐ ট্রাকে ৩০ টি বাছুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল দিশ্যা থেকে ভারুচে। মাঝপথে আহমেদাবাদের রামোল এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। ট্রাকের সহকারী জাহির কুরেশি কে ছুরি মারে গোমাতার রক্ষকেরা। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় জাহিরকে।
বেআইনি গোহত্যা চলছে এই অভিযোগে স্থানীয় জনতা এবং কিছু হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বুলন্দশহরে চিঙ্গরওয়াটি পুলিশ চৌকি আক্রমণ ও তছনছ শুরু করে। ঝামেলার জেরে গুলি চালাতে হয় পুলিশকে। ঘটনায় প্রাণ হারান কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার সুবোধ কুমার এবং আরেকজন ২০ বছরের যুবক। উন্মত্ত জনতা পুলিশ চৌকি এবং সংলগ্ন এলাকায় হামলা করেছিল বলে অভিযোগ।
বিহারের আরারিয়ায় ৫৫ বছরের কাবুল মিঞাকে গবাদি পশু চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারল ৩০০ জনতা। শুধু তাই নয়, মোবাইলে এই নৃশংস হত্যালীলার ভিডিও করা হল। ভিডিওটি ভাইরাল হলে দেখা যায় প্রৌঢ়ের মুখে মাথায় লাথি ও লাঠির আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চিৎকার তুলেছে জনতা। ভিডিও থেকেই শোনা যায় আক্রমণকারীদের একজন সহাস্যে জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছেন লাগাতার আঘাত চালিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষপর্যন্ত এমনকি আক্রান্তের প্যাণ্ট খুলে নগ্ন অবস্থায় তাকে পেটানো হতে থাকে। আঘাতের জেরে ঘটনাস্থলেই মারা যান কাবুল মিঞা।
উৎস : https://p.factchecker.in/, https://lynch.factchecker.in/
অনুবাদ : চান্দ্রেয়ী দে
Link: https://ebongalap.org/violence-and-hate-crimes-in-india