08-03-2024 13:21:04 pm
Link: https://ebongalap.org/women-and-disability-case-studies
◊
স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে ইস্কুলের অন্য ঘরে যাবার জন্য করিডর দিয়ে হাঁটছিলেন সুমনা। এমন সময় কেউ একজন এসে তার স্তন টিপে দেয়, সুমনা শুনতে পায় দুজনের হেসে ওঠার শব্দ এবং তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে যাওয়ার পদধ্বনি। সুমনা দৃষ্টিহীন, কাজেই , কারা তার ওপর এই আক্রমণটি করল, সেটি বোঝা তার জন্য সম্ভব হল না। সুমনা শুনেছিলেন কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হলে তার বিরুদ্ধে আইন আছে এবং কর্মরতা মহিলারা এই আইন মোতাবেক কেস দায়ের করতে পারেন। নিজে যে ইস্কুলের শিক্ষিকা, যেখানে ছেলে ও মেয়েদের সুমনার মত নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে বলে উৎসাহিত করা হয়, সেই ইস্কুল প্রাঙ্গনেই এই হেন যৌন হেনস্থার সম্মুখীন হয়ে সুমনা স্থির করেন তিনি আইনের দ্বরস্থ হবেন।
সুমনা যে ইস্কুলটিতে পড়ান, সেখানে দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করে। শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মীদের মধ্যে দৃষ্টিহীন ও দৃষ্টিমান দুরকম মানুষই আছেন। ইস্কুলটি কলকাতা শহর থেকে দূরে, যাতায়াতের সুবিধার জন্য সুমনা ইস্কুলের কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। সুমনার মা বাবা তার এই সিদ্ধান্তের ভীষণ বিরোধী ছিলেন, কিন্তু এম. এ. পাশ করা সুমনার অদম্য জেদের কাছে তাঁরা হার মেনেছিলেন। সুমনার মত দৃষ্টিহীন মহিলা একা ঘর ভাড়া নেবে মন করাতে বাড়িওয়ালা বেঁকে বসেছিলেন, কিন্তু তার মা এবং ছোটভাই পালা করে এসে তার কাছে থাকার কথা স্থির হওয়ায় সেই সমস্যা মেটে।
সুমনা প্রাথমিকভাবে প্রধান শিক্ষককে নিজের ওপর যৌন হেনস্থার খবর জানান। প্রধান শিক্ষক খানিকটা হাল্কা চালে বিষয়টি উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেন, বলেন দৃষ্টিহীন কোনো বাচ্চা হয়ত ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। এরপর সুমনা ঠিক করেন কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ দেবেন। কিন্তু সুমনার ইস্কুলে কোন Prevention of Sexual Harassment Committee না থাকাতে তাকে ইস্কুল পরিচালনা সমিতিকেই জানাতে হয়। লিখিত অভিযোগ পেয়ে তরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হন। অনেকেই মনে করেন, “অন্ধ মেয়ে চাকরী পেয়েছে, এই না ঢের, আবার অভিযোগ তোলা ইস্কুলের অন্যদের নিয়ে”; আবার কেউ ভাবেন “দৃষ্টিহীনদের ইস্কুলে পড়াতে হলে একটা Charity-র মনোভাব দরকার, নিজের অধিকার নিয়ে সুমনা কেন ভাববেন এতো?” - কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে কিছু মিটিং করেন, সুমনাকে না জানিয়েই বলেন তারা তদন্ত করেছেন এবং এই ঘটনার সাক্ষী যেহেতু কেউ নেই তাই সুমনাকে কেস তুলে নিতে বলেন। প্রধান শিক্ষকের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে তারা বলেন, “অন্ধ বাচ্চারা ইস্কুলে ছোটাছুটি করে, অসাবধানে ধাক্কা লেগে গেছে, এই নিয়ে এত হইহই করার অর্থ নেই”।
অথচ সুমনা জানেন হঠাৎ ধাক্কা লাগা আর জোর করে স্তন টিপে দেওয়ার মধ্যে তফাৎ। সুমনা একজন ২৭ বছর বয়সী নারী এবং দৃষ্টিহীন। স্পর্শের মাধ্যমই তো তাকে পৃথিবীর সবকিছু দেখতে শিখিয়েছে! স্পর্শ চিনতে কি তার ভুল হয়? কিন্তু অভিযোগ তিনি কার বিরুদ্ধে করবেন? হেনস্থাকারীর চেহারা তো তিনি দেখেননি। হ্যাঁ, হাসি শুনেছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে কিভাবে প্রমাণ করবেন সুমনা তার ওপর ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানি? আর অভিযোগ নিয়ে যাবেনই বা কার কাছে? খোঁজ নিয়ে তিনি জেনেছেন যে, শুধুমাত্র দৃষ্টিহীনদের ইস্কুল বলে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সরকার পোষিত (Govt. aided) অন্যান্য ইস্কুলগুলিতেও Prevention of Sexual Harassment Committee নেই। তার কারণ, শিক্ষাদপ্তরের এরকম কোন সার্কুলার ইস্কুলগুলির কাছে নেই।
সুমনাকে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন রাজ্যের ডিসেবিলিটি কমিশনার-এর গোচরে এই খবরটি আনেন। খোঁজখবর করে জানা গেল, এই কমিশনের অফিসটি “disability specific’’ অভিযোগগুলি নিয়ে কাজ করেন; কিন্তু যৌন হেনস্থা, তা প্রতিবন্ধী নারীর ওপর হলেও, তারা কেস হিসাবে গ্রহণ করেন না!
◊
সুমনা নামটি এখানে বানিয়ে বললাম, কিন্তু ঘটনাটি বানানো নয়। সুমনার মত প্রতিবন্ধী নারীরা আজও কিন্তু নারীকেন্দ্রিক আইনব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধীকেন্দ্রিক আইনব্যবস্থার সুযোগসুবিধাগুলি পান না। যদিও আইন আছে তাদের পক্ষে, কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। সুমনার মনে হয়েছিল অভিযোগ তুলে নেওয়াই ভালো, কারণ চাকরীটা করতেই হবে। তার অন্য চাকরী পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। সেন্সাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে ৭৭.৪ (77.4) শতাংশ নারী কোনও রকম কাজের সাথে যুক্ত নয়। প্রতিবন্ধী পুরুষদের মধ্যেও ৫২.৮ (52.8) শতাংশ কর্মহীন। এইরকম অবস্থানে দাঁড়িয়ে সুমনারা নিরাপদ কর্মস্থল দাবী করবেন কী উপায়ে?
তা সত্ত্বেও সুমনারা চান ৮ই মার্চের মিছিলে হাঁটতে - বিশ্বের সব নারীদের মত ‘সুরক্ষিত’ কাজের দাবীতে। নারী আন্দোলন প্রতিবন্ধী নারীদের কথা ভাবেনি - এই অভিযোগ নিয়ে কাল কাটিয়ে লাভ নেই, সুমনার মত অনেক নারীই তা জানেন। সবার সাথে একসাথে পায়ে পা না মেলালে তাঁরা আরও পিছিয়ে পড়বেন এমনটাই বিশ্বাস। পথই নতুন পথ দেখায়, বাধাবিঘ্নকে জয় করতে শেখায়, এই খবর প্রতিবন্ধী নারীরাই সবথেকে বেশী জেনেছে তাদের জীবন থেকে।
Link: https://ebongalap.org/women-and-disability-case-studies