04-06-2024 12:23:35 pm

print

 
Ebong Alap / এবং আলাপ

এবং আলাপ

জেন্ডার | সমাজ | নাগরিকত্ব

Ebong Alap

Gender | Society | Citizenship

 

চাকুরে কন্যার কাহিনি (প্রথম পর্ব)


Yashodhara Ray Chaudhuri
https://ebongalap.org/author/yashodhara1965/
April 30, 2017
 

Link: https://ebongalap.org/working-women-story-part-01

অফিসে কাজের টেবিলে আরতি (মহানগর)

ওয়াটস্যাপে ঘুরে বেড়ায় যে সব জঘন্য বাংলায় লেখা নারীবিরোধী জোকস, তারই একটি সংগ্রহ করে রেখেছিলাম...আপনাদের জন্য দিলাম।

“একটি ATM এ পুরুষ আর মহিলাদের জন্য আলাদা দিশা-নির্দেশ দেওয়া দেখলাম....

ATM ব্যাবহারের দিশা নির্দেশ ৷

পুরুষদের জন্য:

  1. স্বাগতম৷
  2. আপনার কার্ড বারকরে ATM মেশিনে প্রবেশ করান৷
  3. আপনার কার্ডটি বের করে নিন৷
  4. পিন নম্বর টাইপ করুন৷
  5. রাশি/টাকা টাইপ করুন৷
  6. টাকা এবং রসিদ সংগ্রহ করুন৷
  7. আপনার লেন-দেন সম্পূর্ণ হয়েছে৷
  8. এই ATM ব্যবহার করার জন্য ধন্যবাদ৷

মহিলাদের জন্য নির্দেশাবলী:

  1. হে ভগবান৷
  2. আপনার হ্যান্ডব্যাগে রাখা সব জিনিষ, পাশে রাখা টেবিলে ঢালুন এবং আপনার ATM কার্ডটিকে সহজে খুজে বার করুন৷
  3. কার্ডটি খুজে পেয়ে থাকলে, ATM এ প্রবেশ করান৷
  4. কার্ডটি বার করুন এবং আবার সঠিক ভাবে প্রবেশ করান৷
  5. এবার টেবিলে রাখা অন্যান্য জিনিষগুলির মধ্যে আপনার ওই ছোট্টো ডাইরীটা খুলে আপনার পিন নাম্বারটি খুজে বার করুন৷
  6. হ্যান্ডব্যাগের আয়নাতে মেকআপ চেক করে নিন একবার৷
  7. ডায়রীতে লেখা পিন নাম্বারের প্রত্যেকটি সংখ্যার নিচে আঙ্গুল রেখে, এক এক করে খুব সাবধানে পিন নং এন্ট্রী করুন৷
  8. বাইরে লাইনে দাড়িয়ে থাকা অধৈর্য জনতাকে হাতের ইশারায় ২ মিনিট অপেক্ষা করতে বলুন৷
  9. আপনার পাসবই বার করুন, তার ভেতরে রাখা আপনার লাস্ট ট্র্যান্সেকশনেরর রসিদ থেকে ব্যালেন্স চেক করুন৷
  10. এবার আবশ্যক টাকার এন্ট্রী খুব সাবধানে করুন৷
  11. টাকা সংগ্রহ করুন এবং ভাল ভাবে গুনে নিন৷
  12. রসিদ সংগ্রহ করুন এবং ভাল ভাবে চেক করুন৷
  13. চেক করুন আপনার মোবাইলে transaction এর মেসেজ এসেছে কি না৷
  14. যদি মেসেজ এসেছে তবে রসিদের সাথে মিলিয়ে নিন৷
  15. যদি মেসেজ না এসে থাকে তবে, আপনার husband/boyfriend/father/brother-কে ওখান থেকে ফোন করে কি করবেন সেটা জেনে নিন৷
  16. টেবিলে ছড়ানো ব্যাগের জিনিসগুলোকে আবার ব্যাগে ভরে নিন আর ব্যাগ বন্ধ করার আগে মেকআপটা আরো একবার চেক করে নিন৷
  17. আপনার transaction সম্পূর্ণ হয়েছে৷
  18. এই ATMটি ব্যবহার করার জন্য ধন্যবাদ৷

বিঃদ্রঃ বাইরে বেরিয়ে, লাইনে দাঁড়ানো জনতাকে সরি বলতে ভুলবেন না দয়া করে৷”

অবশ্যই এই জোকটি পড়ে প্রথম শিবরামের সেই গল্পটি মনে পড়ল, কন্ডাকটর ও জজসাহেবের কথোপকথন। এটা আসলে বহু পুরনো জোক। আমার মায়ের হাতব্যাগ, বা থলির ক্ষেত্রেও এই জোক প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু এখনকার সরু সরু মেয়েদের দ্রুতগামিতা ও কর্মপটুতা এতটাই যে এ জোকের বর্ণিত মহিলাদের ধারণাটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে বহুদিন আগে।

বাস্তবে এখন কোন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এই জোকের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে বেশি খাপ খেয়ে যাবেন, আর কোন চটপটে চাকুরে তরুণী এর প্রথম অংশের সঙ্গে। আমাকে প্রথম প্রথম এটিএমে ঢুকে প্রথম অংশের সঙ্গে লাগসই কোন তরুণীর কাছ থেকে টাকা তোলা বুঝে নিতে হত...

কিন্ত কথায় বলে স্টিরিওটাইপদের মৃত্যু হয়না, ওই উপরিউক্ত জোকই তার প্রমাণ। স্টিরিওটাইপ নিয়ে ছোটবেলায় একটা সহজ সুন্দর কার্টুন দেখেছিলাম, যে সময়ে নারীবাদে হাতেখড়িও হয়নি।

একটি  মেয়ে তার বাবাকে জিগ্যেস করছে, বড় হয়ে আমি কী হব, বাবা?
বাবা বলছেন, তুই ডাক্তার হতে পারিস।
মেয়ে বলছে, কেন, কেন, আমি তো নার্স হব। ডাক্তার তো ছেলেরা হয়।
বাবা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন।

এই একই কথা ছোট্টবেলায় আমাদের মাথায়ও আসত। তখনো পৃথিবীতে নারীপুরুষের সংজ্ঞায় অনেক কিছু শিখতে বাকি। ইংরিজি ছবির বই মাত্রেই, সাদা পোশাকের ডাক্তার পুরুষ আর সঙ্গের নার্স মহিলা। এর ব্যত্যয় দেখিনি কখনো। প্রশ্নটা ওই ছোট্ট মেয়েরই মত মাথায় এসেছে অবচেতনে কখনো না কখনো।

বড় হয়ে গেলাম কবে যেন। কিন্তু অজস্র বান্ধবী ডাক্তার হবার পরে, অসংখ্য বিজ্ঞাপন, ছায়াছবি, ম্যাগাজিনের ছবি সবকিছুতে মেয়ে ডাক্তারদের ছবি ছাপার পরে, আজ মাথার মধ্যে আমার অন্য প্রশ্ন জাগে।

কতখানি মুক্ত, কতখানি সহজ, কতখানি অনায়াস ডাক্তারির জগতে মেয়েদের হাঁটাচলা?

দুটো ছোট ঘটনা মনে পড়ছে। এক, এক চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডাক্তার (পুরুষ তিনি) এর স্ত্রী গাইনোকলজিস্ট। ছেলের পরীক্ষার আগে মা হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলেন, বাবা নেন নি।

দুই, আমার বান্ধবী, ডাক্তারিতে ভাল রেজাল্ট করেও বিয়ের পর ১৫  বছর কোন কাজে যোগ দিতে পারেনি, কেননা ছেলে ছোট আর শ্বশুরবাড়িতে বলা হয়েছিল, আমাদের ছেলের যা মাইনে, তাতে বউমার চাকরি করার দরকার কী? এতে পরিবারের অসম্মান।

আজকের দিনে যে মেয়েরা ডাক্তারি পাশ করে বেরোয়, তাদের মনে হয় এই “স্বাভাবিক” ডিসক্রিমিনেশনের মুখোমুখি হতে হয় না!

যা হোক, যে ক্ষেত্রটা বেশি চিনি, তা নিয়েই দু চার কথা বলি বরং।

আমি যে চাকরিটা করি, সেটা ভারতের সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবছর কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন আট থেকে নশোটা ফাঁকা পদ পুরণ করে একটা পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই পরীক্ষায় যারা ছাঁকনিতে ছেঁকে ওঠেন, তাঁদের মধ্যে আবার মেরিট অনুসারে, এবং তাঁদের পছন্দের তালিকা অনুসারে, নানা সার্ভিসে অ্যালট করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, কে বাকি জীবন কী কাজ করবেন সেটা নির্দিষ্ট হয়ে যায় পরীক্ষার ফল বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই। সুতরাং, ১৯৯১ সালের পরীক্ষার ভিত্তিতে আমার চাকুরিপ্রাপ্তির পর পরই নির্ধারিত হয়ে যায়, আমি ভারতীয় অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের সদস্য হব।

ভাগ্যক্রমে, এই সার্ভিসটি আমার পছন্দের তালিকাতেও ছিল। যদিও ওই পরীক্ষাটি দিতে যারা যায় তাদের অভীষ্ট থাকে আইএএস বা ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যোগ দেওয়া (যার ফলে পরীক্ষাটার একটা মোটা দাগের নাম হয়ে গেছে আইএএস পরীক্ষা), কিন্তু বছর বছর আইএএসের ভেকেন্সি বা ফাঁকা পদের সংখ্যা পালটে যায় এবং অতি বড় ভাগ্যগণকও বলতে পারবে না, কে আইএএস পাবে কে পাবে না।

ভারতে আইএএসের সম্বন্ধে বলা হয়, রাজার সার্ভিস। কেন তা বলা হয়? কেননা, ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিসট্রিক্ট কালেকটরের যে মূর্তিটি একদা নয়া জমিদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল (শোলা হ্যাট ও সাইকেল সহকারে), তা ক্রমে ক্রমে ওয়েলফেয়ার স্কিম অর্থাৎ সরকারের যাবতীয় দান খয়রাতের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের মূল কাঠামোটা আইএএসদের মধ্যে দিয়েই জনগণের সঙ্গে যোগ রেখে চলে, অন্যদিকে, এই সার্ভিসটি প্রকৃতপক্ষেই সরকারের ডানহাত হিসেবে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। অসুবিধা যে কিছু নেই তা নয়। যেমন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ করলে, তার ফল হতে পারে সপাটে অন্যত্র পোস্টিং, বোরা বিস্তর বেঁধে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হতে পারে।

পুলিশ অথবা বিদেশ সেবা, এ দুটোরও দিব্যি জাত আছে জনমানসে। পুলিসের যে ধারাটি আসছে ঐ সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা থেকে, তার নাম ইন্ডিয়ান পুলিস সার্ভিস, বছর ছ’ সাত চাকরি করলেই জেলার পুলিস সুপার হতে পারার সুযোগ। বিদেশ সেবা একদা খুব প্রীতিকর ছিল। এখন তার কদর কমেছে, কেননা প্রবাসে, বান্ধবহীন অবস্থায়, গুটি কয়েক অধস্তন ভারতীয়কে নিয়ে, নির্জন কোন দ্বীপে বা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি শীতে পোস্টিং করার তুলনায়, ভারতের ভেতরেই পোস্টিং করাটা সবার কাছে আকর্ষণীয়। সবচেয়ে বড় কথা, হাতের ভেতর দিয়ে কতটা টাকা গলছে তার হিসেবেই মাপকাঠিটা বাঁধা হচ্ছে। একজিকিউটিভ সার্ভিস, এঁদের হাত দিয়ে টাকাপয়সার সরাসরি লেনদেন চলে, কেননা এঁদের হাত দিয়েই রূপায়িত হয় সরকারের কাজের রূপরেখা।

আমার সার্ভিসটি এই সবের তুলনায় কম উল্লিখিত, জাত আছে তবে বেশি কেতাবি, তুলনামূলকভাবে ডেস্ক জব। নাইন টু ফাইভ জব। কেননা, আমাদের কাজ শুরু হয় পোস্ট মর্টেম হিসেবে। যখন শেষ হয় একজিকিউটিভের কাজ, তখন শুরু হয় অডিটের কাজ। নিয়ম কানুন মেনে টাকা খরচ হয়েছিল কিনা, তা থেকে শুরু করে, যে টাকা খরচ হয়েছে, তার সবটাই উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রে পৌঁছেছে কিনা, সবটাই দেখার কাজ করেন অডিট ডিপার্টমেন্টের লোক। ফলো দ্য রুপি, বা একটা টাকা মূল থেকে গন্তব্য অব্দি পৌঁছল কিনা তা গোয়েন্দার মত পিছু নিয়ে ট্র্যাক করার কাজটাই আমরা করে থাকি। এই টাকা অবশ্যই হতে হবে সরকারি টাকা, কনসলিডেটেড ফান্ডের থেকে যার উৎস।

(চলবে)

Link: https://ebongalap.org/working-women-story-part-01

print

 

© and ® by Ebong Alap, 2013-24