• পুরুষ মানুষ : অলোক - এক লিঙ্গঅতিক্রমী ভালোবাসার সম্ভাবনা


    1    308

    July 20, 2018

     

    আজকাল অলোকের মাঝে মাঝে একটা ভয় হয়, আচ্ছা পুরুষ মানুষ ব্যাপারটাই কি আস্তে আস্তে অবান্তর হয়ে যাচ্ছে? মেয়েদের কাছে? ভয়টা কেবল তার ব্যক্তিগত তা নয়। তার বয়স এখন ষাট পেরিয়ে একষট্টি পেরনোর পথে। তার জীবনে এই মু্হূর্তে আর নতুন করে মেয়েদের আর্বিভাবের সম্ভাবনা তেমন করে নেই। কিন্তু তাহলেও সে তো নিজে পুরুষ, আগামী সমাজে তার মতো পুরুষদের আর তেমন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই, ভাবনাটা খুব সুখের নয়। তার জীবনে জেন্ডার নিয়ে ভাবনা এসেছিল, সামাজিক বা শ্রেণি সাম্য নিয়ে ভাবনা মাথায় ঢোকার অনেক পরে। যখন প্রশ্নটা মাথায় ঢুকেছিল, তখন নিজের জীবনে দেখা মেয়েদের নিয়ে ভেবে সে বুঝেছিল সত্যি মেয়েদের অনেক অধিকার সমাজ দেয় না। তাই নিজের মত করে সে নিজেকে জেন্ডার সাম্য-কামী করে তুলেছিল, যতটা পেরেছে, এই মতের প্রকাশ বা কাজ করেছে। আজকে অনেক প্রশ্ন তার কাছে পরিষ্কার নয়, যেমন জেন্ডার সাম্য আর নারী স্বাধীনতা কি এক? মনে হয় না। অধিকারটা কেড়ে নিতে হয়, স্বাধীনতার ধারণা আর ধরন নিজেদের তৈরি করতে হয়। জেন্ডার সাম্য চাইতে গেলে যদি ফেমিনিস্ট হতে হয় তবে সে নিশ্চয় ফেমিনিস্ট। নারী স্বাধীনতাকে সে অধিকারের দিক থেকে সমর্থন করতে পারে, কিন্তু তার প্রকাশ, গতিবিধির বিষয়ে তার কোনও অধিকার আছে কি? বোধ হয় না।


    অলোকের মনে হয়, এই সমস্যাটা পুরুষ মানুষের, হয়তো বেশি করে মধ্যবিত্ত পুরুষ মানুষের। তার বাবা কাকারা চাষি আর মজদুরদের নামে আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। তাদের অনেকে চাষি মজুরদের হয়ে নাটক লিখেছিল, সিনেমা বানিয়েছিল, গান লিখেছিল। কিন্তু তারা তো চাষি মজুর ছিল না। সেই মানুষগুলোর মনে প্রবেশ তারা করতে পেরেছিল কি? না কি এক অসম সমাজে সুবিধাভোগী হয়ে বাস করার পাপবোধ থেকে যতটুকু পারে করেছিল। ঠিক যে রকম ভাবে সে নিজে নারীবাদী হয়েছে।  তার মনে আছে, এক সময় বাম আন্দোলনে আমেরিকার কালো মানুষদের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ আন্দোলন নিয়ে জোর তর্ক বেধেছিল।  একটা তর্ক সামনে উঠে এসেছিল উৎপল দত্তের ‘মানুষের অধিকারে’ নাটকটা নিয়ে। যত দূর মনে আছে সেই নাটকে কালো মানুষদের আত্ম পরিচয়ের আন্দোলন সমর্থিত হওয়ায়, শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলন বিশ্বাসী বামেরা নাটকটাকে তিরস্কার করেছিল। নারী আন্দোলনের তো একই সমস্যা হয়েছিল। বামেরা বলেছিল এই আন্দোলন শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলনকে বিভক্ত করে। কিন্তু অলোকের সমস্যা আর এই সব তত্ত্ব নিয়ে নয়। ইদানিং তার মনে হয়, বহু তত্ত্বের ভিত খুব গোলমেলে। সে তো পণ্ডিত নয়, কিন্তু রুশ বিপ্লব নিয়ে যত পড়ছে, ওই বিপ্লব, শ্রেণি ইত্যাদি নিয়ে এই দেশে যে সব ধারণা চালু ছিল তার অনেকটাই বানানো বলে মনে হচ্ছে। তার মানে এই নয় সে ধনতন্ত্রের সমর্থক হয়ে উঠেছে, কিন্তু বাম রাজনীতির কাঠামো একটা সঠিক অনুভূতিকে আবার অন্য এক কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করেছে বলেই তার ক্রমশ বেশি বেশি করে  মনে হচ্ছে। উত্তর সে জানে না, সেই যোগ্যতাও তার নেই। সে কেবল আকাশ পাতাল ভাবতে পারে। হয়তো নানান ছোটখাটো আন্দোলন চলতে থাকবে, শেষ যুদ্ধ বলে কিছু নেই।

    এই সব ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয় জেন্ডার নিয়ে আমাদের এখানে কথা বলার একটা সুবিধা হল যে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে হয় না। সামাজিক লিঙ্গ কথাটা যেন একটা স্বস্তি দেয়, যাক বাবা শারীরিক লিঙ্গ নিয়ে কথা বলতে হবে না। অনেক নারীবাদীদেরও সে দেখেছে, যৌনতা নিয়ে কথা বলতে গেলেই, থাক থাক, ‘ওই গানটা আবার কেন, ওটা তো নয়, আরেকটা গান আছে’ এই রকম একটা ভাব। জেন্ডার সাম্যের গোড়ার কথা তো নারী পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কে সামাজিক অসাম্য দুর করা। তত্ত্বগত ভাবে জেন্ডার বলার চেষ্টা করে যে পুরুষের তুলনায় নারীর শরীর মনে অক্ষমতার ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়ে, পরিবার পরিপালন ও সন্তান উৎপাদন নারীর মূল কাজ ধরে নিয়ে, সমাজে লিঙ্গ অসাম্য কাজ করে চলে। আমাদের দরকার তাকে প্রশ্ন করা, বিরোধিতা করা। পুরুষতন্ত্রের কাজ হল পুরুষের শরীরজাত শক্তির সামাজিক আধিপত্য জারি করা।

    এই আধিপত্যের গোড়ার কথা সন্তান প্রসবে পুরুষের গুরুত্ব ও ফলে সামাজিক ভাবে যৌনতায় পুরুষের প্রভুত্ব। সন্তান-বংশ-উত্তরাধিকার এই সম্পর্কগুলোই পুরুষতন্ত্রের ভিত্তি। নারীকে বশে রাখার জন্য এই গল্পকেই নানান সামাজিক শেকল দিয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাকি সব দিক বাদ দিলেও, এই গল্পের মূল কেন্দ্রই হল পুরুষের লিঙ্গপ্রবেশ, বীর্য ক্ষরণ, নারীর গর্ভধারণ এবং আদর্শ কাহিনিতে পুং সন্তানের জন্মদান। এই গল্পটাকে নারীর কাছে সহনীয় এবং কাম্য করে তোলার জন্য যুগে যুগে এই লিঙ্গপ্রবেশের অপার্থিব, নারী জীবন সার্থককারী আশ্লেষের গুণগান গাওয়া হয়েছে। পুরুষকেও বলা হয়েছে, তোমার কোনও বিকল্প নেই, ভয় নেই ‘তোমার আছে যে লিঙ্গখানি’। আর এই ভাবে, যুগে যুগে, ব্যাঁকা, ট্যাড়া, হড়বড়ে, বেঁটে, লম্বা পুরুষ, দজ্জাল শাশুড়ি, বজ্জাত ননদ, গায়ে হাত দেওয়া শ্বশুর, হাত না দেওয়া স্বামী সব মেনে নিয়ে মেয়েদের চলতে হয়েছে। কিন্তু যদি আর না হয়?

    অলোক যখন লিঙ্গ সাম্যের কথা ভাবে, ওর চোখের সামনে ফুটে ওঠে নিজের ছোট বেলার খেলার সাথী মেয়েদের মুখ, শরীর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাদের খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টেলিভিশনের প্রোগ্রাম করতে গিয়ে আলাপ হওয়া গিন্নীদের মুখ যাদের অনেকের গান গাওয়া বন্ধ, চাকরি করা বারণ, লুলা বর, এমন কী মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা স্বামী, কিন্তু কোথাও যাওয়ার পথ নেই, শিক্ষা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও না। অনেকেরই জীবনের ফোকাস ‘কোল আলো করা সন্তান’, অনেকেরই দু:খের কারণ পর পর দুটি কন্যা। এই জীবন নদীর ওপারে দাঁড়ায়ে কে? পুংলিঙ্গ? আর তার প্রবেশের আশ্লেষ?

    কিন্তু আজকে তো সমকামী আন্দোলন যৌনতাকে এই জন্মবৃত্তান্ত থেকে ছাড়িয়ে আনছে, পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে প্রেম আজকে বলছে, প্রজনন যৌনতার এক মাত্র কারণ নয়, হতে পারে না। যৌনতার আশ্লেষের বিস্তার আরও বড়, আপন কারণেই সে স্বত:সিদ্ধ। আজকে আমরা বুঝতে শিখছি, যে বিষমকাম আর সমকাম ১৮০ ডিগ্রি দূরত্বের দুটি বিন্দু নয়, একটাই বিস্তৃত দিগন্ত। যাতে দুই বিপরীত চরম বিন্দুতে অবস্থান যেমন সম্ভব, মধ্যবর্তী নানান বিন্দুতে দাঁড়ানো সম্ভব, আবার নানান সরে সরে যাওয়া স্থানাঙ্কও সম্ভব। কেউ যেমন একনিষ্ঠ সমকামী বা বিষমকামী হতে পারে, কেউ তেমন কম বেশি উভকামী হতে পারে, কেউ জীবনের যাত্রায় তারার আলোয় কামের অবস্থান বদলাতেও পারে, তাতে সর্বনাশ হয় না।  

    অলোকের মনে হয় আর এখানেই পৌরুষ আজকে পুরুষদের বিপদের কারণ। সাদাদের যে সব খারাপ ছিল তা তো নয়। তারা আর পাঁচ জনের মত অনেক শিল্প তৈরি করেছিল, নাটক লিখেছিল, কিন্তু তারা যখন ঔপনিবেশিকতার সরু মুখের ফানেল দিয়ে তাদের গোটা অস্তিত্বটাকে শ্বেতপ্রভুত্বের বিষ-অস্ত্র করে তুলে উপনিবেশের কালো মানুষদের গিলিয়েছিল, তখনই তাদের গা-জোয়ারির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছিল।

    পুরুষরা কি খারাপ? কামনার বিভিন্ন কিনারায় দাঁড়িয়ে তাদের তো চাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু পৌরুষ যদি কেবল জীবনছেদী লিঙ্গ হয়ে ওঠে তবে? তাই কি আজকে আমরা দেখছি যে মেয়েরা পারছে, তাদের কেউ কেউ ভাবছে, এর জন্য এত? কেন? গল্পটা যদি শুধু লিঙ্গের হয়, আর তাকে ঘিরে থাকে একটা গোটা জীবনের নানান বাধা নিষেধ, কী প্রয়োজন আমার? অলোক জানে এই গল্প কেবল প্রথম থেকেই মানসিক ভাবে সমকামী মেয়েদের গল্প নয়, অনেক মেয়ে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে লিঙ্গদাসত্বহীন স্বাধীনতর জীবন কল্পনা করছে, এগোচ্ছে। আর কেবল লিঙ্গের অর্গানিক ইনর্গানিক বিকল্প বাজারে আছে। তার জন্য চাকরি ছাড়ার, গঞ্জনা শোনার, জীবনে আর প্যান্ট না পরার দরকার নেই। আশ্লেষের সংকট হবে না। বরং সামাজিক মুক্তি তাকে তীব্রতর করে তুলতে পারে।

    অলোকের মনে হয়, এই ওলটপালট পুরুষদের কাছে আবার সংকটের পাশাপশি আবার একটা নতুন সম্ভাবনাও এনে দিয়েছে। এক লিঙ্গঅতিক্রমী ভালোবাসার সম্ভাবনা। যৌনতাকে ‘যাহা কিছু আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভুবন ছাপিয়া, জীবন ব্যাপিয়া’ সন্ধানের সুযোগ। ভিন্নতাকে নতুন করে খোঁজার আর বোঝার বৃহত্তর এক ভুবন। অলোকের কমপিউটারে ইউটিউব। গান গাইছেন সুমন, রবীন্দ্রনাথের গান: ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো....’। এই সুমনই তো গেয়েছেন, ‘না পাওয়ার রং নাও তুমি’। ‘না পাওয়া’-কে ভাগ করার ভালোবাসাই তো যৌনতাকে অশেষ করে, এমনই লীলা তব।

    নোট: অলোক বিষমকামী পুরুষ, তাই এই আলোচনার সীমাবদ্ধতা হল এতে সমকামী পুরুষদের বিষয় নিয়ে আলোচনা নেই লেখক এই খামতি স্বীকার করে নিচ্ছে কেউ যদি এই নিয়ে আলোচনা বাড়ান ভালো হয়

     
     



    Tags
     



    1 Comment

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics