• রঙ লায়ে সঙ্গ : নজরে সার্ফ এক্সেল


    4    575

    March 21, 2019

     

    সাম্প্রদায়িকতা বা সম্প্রীতি, নারীবিদ্বেষ বা নারীমুক্তি- কোনো বিজ্ঞাপনের আপাত বার্তা যা-ই হোক না কেন, বিজ্ঞাপন-জগতের মূল নীতি ও উদ্দেশ্য হল উৎপন্ন দ্রব্যের বিপণন। সার্ফ এক্সেলের সাফল্য এখানেই যে আপনি চান বা না চান, ২০১৯ সালের দোল/হোলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে গেছে তাদের নতুন বিজ্ঞাপনটি এবং তাকে ঘিরে বিতর্ক। দিনকয়েক আগেই ট্যুইটারে হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের পাতায় বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ পাওয়া মাত্র চাপান-উতোর শুরু হয়েছে৷ একদল হিন্দুত্ববাদী এই বিজ্ঞাপনে ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কারণ এখানে ‘হিন্দু উৎসব’ হোলির হাত থেকে মুসলমান শিশুকে বাঁচাতে হচ্ছে! ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কারণ তাঁরা ‘লাভ জিহাদ’-এর ভূত দ্যাখেন যত্রতত্র। অন্যদিকে সম্প্রীতি-পন্থীরা এই বিজ্ঞাপনকে স্বাগত জানিয়েছেন। পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি একমাত্রিক মত যেহেতু আমরা শুনে নিয়েছি, তাই আর যে যে স্তরে এই বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনা হতে পারত কিন্তু হয়নি, তা নিয়ে দু-চার কথা বলি৷ তার আগে, আরেকবার চোখ বোলানো যাক বিজ্ঞাপনটিতে।

     

    আপাতদৃষ্টিতে ভারি নিষ্পাপ একটি বিজ্ঞাপন, যা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে বন্ধুত্বের কথা বলে। এক মিনিটের স্ক্রিপ্টে বোনা আছে বিভিন্ন ধর্মের শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও আস্থার একটি নজির। বলা হয়েছে, ‘রঙ লায়ে সঙ্গ।’ বলা হয়েছে, ভালো কাজ করতে গিয়ে দাগ লাগলে, সে দাগ ‘আচ্ছে হ্যায়’। এই ভালো কাজটি কী?

    ফেজ পরিহিত এক খুদে রঙের ভয়ে নামাজ পড়তে যেতে পারছে না। মসজিদে সাফসুতরা যাওয়ার নিয়ম। সাইকেল-আরোহী মেয়ে-বন্ধুটি তাই যেচে পাড়ার সব শিশুর থেকে সব রঙ মাখলো নিজের গায়ে, তবে আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখেই। তল্লাটের সব বাচ্চাদের বালতি-বেলুন-পিচকিরি খাঁ খাঁ করছে যখন, তখন ছেলেটিকে ডেকে নিল সে, ক্যারিয়ারে চাপিয়ে তাকে পৌঁছে দিল মসজিদে। ধোপদুরস্ত মুসলমান শিশুটির গায়েও রঙ পড়বে, কিন্তু নামাজের পর, এমনটা জানিয়ে বিজ্ঞাপন শেষ হল৷ শিশুদের পৃথিবীতে দ্বেষ নেই, হিংসা নেই- এই ফিল গুড ফ্যাক্টর ক্রেতাদের মুগ্ধ করল৷

    তবে, বিজ্ঞাপনটি আরও একটি ক্ষেত্রে সুনিপুণ ভাবে খেলা করে গেছে, যা অনালোচিত৷ নারী-পুরুষের সমাজ-নির্দিষ্ট ভূমিকার অদল-বদল বা ‘রোল রিভার্সাল’ এই বিজ্ঞাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মেয়েটি এখানে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়৷ ছেলেটির আনাগোনা ভীরু পদক্ষেপে৷ পিতৃতান্ত্রিক ন্যারেটিভে সচরাচর ঠিক এর উল্টোটা ঘটে। মেয়েটি ঢাল হয়ে দাঁড়ায় প্রার্থনায় ইচ্ছুক একটি ছেলের সামনে। তার বুদ্ধিপ্রয়োগ, ক্ষিপ্রতা এমনকি কথার ভঙ্গিতে ক্ষমতায়নের ভাষা সুস্পষ্ট। এমন দাপুটে ছোট মেয়েকে নারী-ক্ষমতায়নের স্বপ্ন-দেখা শহুরে ক্রেতার ভালো না বেসে উপায় নেই৷

    কনসেন্টের ধারণাও সুন্দরভাবে উপস্থাপিত। অবশিষ্ট একটি বেলুন ছুঁড়ে দেওয়াই যেত দুষ্টুমি করে। কিন্তু এক দুষ্টু ছেলের উদ্যত হাত ধরে ফ্যালে অন্য এক রঙিন মেয়ে। কারণ সাইকেলের পিছনে বসা ছেলেটির সাদা জামায় অদৃশ্য ‘না’ স্পষ্ট লেখা । সম্মতি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, এমনকি দোল বা হোলির দিনেও৷ তা না হলে, রঙের উৎসবের আড়ালে যেমন অনিচ্ছুক মানুষের অনিচ্ছা চাপা পড়ে যেতে পারে, তেমন যৌন নির্যাতনও ঘটতে পারে।

    কিন্তু স্থান ও কাল আমাদের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। ভেবে দেখলাম, অতিহিন্দু ভারতে এই মুহূর্তে বাস না করতে হলে সম্প্রীতির প্রশ্নেও এই বিজ্ঞাপনের বিশ্লেষণ হয়ত খানিক বহুস্তরী হতে পারত৷ তারও একটু আভাস দিয়ে রাখি৷ মুঘল দরবারে হোলিকে বলা হত ইদ-এ-গুলাবি। অক্ষম সম্রাট, কিন্তু মরমি কবি, বাহাদুর শাহ জাফর গান লিখতেন হোলি নিয়ে৷ মুসলমানরা এদেশে বড় আগ্রহ নিয়ে হোলি খেলেছেন এতকাল ধরে। হোলি ‘হিন্দু উৎসব’ -এমনটা শুনলে সবচেয়ে দুঃখ পাবেন হয়ত সুফি সাধকেরা। তাই ভারতবর্ষের সম্প্রীতির ইতিহাস মাথায় রাখলে, বিজ্ঞাপনের মুসলমান শিশুর হোলির রঙে ছুঁৎমার্গও খুব সহজ ঠ্যাকে না। এই ছুৎমার্গকে কীভাবে দেখব আমরা? গোঁড়ামি? না অতি-হিন্দুত্বের আবহে ডিফেন্স মেকানিজম?

    অথচ সুফি ঘরানার যাপনে আর গানে ছিল হোলির নিত্য আনাগোনা৷ নিজামুদ্দিন আউলিয়া ও তাঁর ভক্ত আমির খসরো হোলির রঙে মজে থেকেছেন। খসরো লিখেছেন:

    ‘আজ রঙ হ্যায় হে মা, রঙ হ্যায় রি ,মোরে মেহবুব কে ঘর রঙ হ্যায় রি...’

    ‘মেহবুব’ এখানে আরাধ্য নিজামুদ্দিন স্বয়ং। বুল্লে শাহ ‘আল্লাহ্’-র নাম নিয়ে হোলি খেলার কথা বলেছেন:

    ‘হোরি খেলুঙ্গি কে বিসমিল্লাহ / নাম নবি কে রতন চড়ি, বুঁদ পড়ি ইল্লালাহ্…’

    সেসব ছিল বড় সাবলীল সাংস্কৃতিক মেলামেশা৷ কোনো কিছু ‘বিশেষভাবে জ্ঞাপন করা’-র দায় সেখানে ছিল না। আর একটি সুফি গান দিয়ে শেষ করি৷ হজরত শাহ নিয়াজ লিখেছিলেন:

    ‘হোরি হো রহি হ্যায়, আহমদ, জিয়া কে দ্বার...’

    হে প্রভু,হৃদয়ের দুয়ারে আজ রঙের উৎসব...

    প্রাণের আঙিনায় রঙ লাগুক। ধর্ম-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণিগত বিভেদ মুছে যাক৷

     
     



    Tags
     



    Comments (4)
    • মুসলমান ছেলেটির নামাজের পরে “রং পড়ে গা” শুনে মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ানোয় তার রঙ খেলা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি রকমের ছুঁৎমার্গ আছে বলে মনে হয় নি। নামাজটুকুর জন্যই তার ওই প্রোটেকশন এর দরকার ছিলো বলে মনে হল। ? সব মিলিয়ে বিজ্ঞাপনটি ভালো লেগেছে এবং মেয়েটি বয়সে বড় , অন্তত লম্বায়, সেটা দেখা যাচ্ছে ফলে এখানে মেয়ে হয়ে ছেলেটিকে রক্ষার সঙ্গে বড় দিদি হয়ে ছোট ভাইকে রং এর হাত থেকে বাঁচানোর ধারণাও সামনে আসে। অনেকটা ভারতীয় সংস্কৃতির ভায়ের মায়ের এত স্নেহ টাইপের ব্যপার আর কি… ? সুফী সাধকদের উল্লেখ যথাযথ। ভালো লাগল

    • শুধু দোল কেন ঢেড় মুসলমান দুর্গাপূজার আয়োজন করেন উৎসাহে শ্রদ্ধায়।
      আমার হাতের কাছেই চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্যর মুসলমানের দুর্গাপূজা বইটা আছে। আজই এই বইটিকে বোলপুরের একটি সংস্থা স্বীকৃতি সম্মাননা জানাচ্ছে। এসবতো আছেই।
      তবে লেখাটায় সেই ডাউট এভরিথিং বা ঐ বিখ্যাত গরুর রচনার আদল বেশ চেনা যায়।

    • অসাধারণ লেখা| গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করে সাবলীল ও ইতিহাসানুগ বিশ্লেষণ ।

    • খুব ভালো লাগল। ছোটো পরিসরে সহজ-সাবলীল ঠাসবুনোট লেখা। খুবই ভালো।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics