• গৌরীকেন্দ্রিক একটি বই ও হাতে হাত রাখার কিছু গল্প


    2    181

    February 9, 2018

     

    বেঙ্গালুরুর বাড়ির সামনে বাগানটুকু গৌরীর খুব প্রিয় ছিল। তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই সাপের উপদ্রবে মা ইন্দিরা বাগানের ঝোপঝাড় মুড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেয়ে রাগ করেননি। সেই নিড়ানো জমিতে সবজি চাষের পরিকল্পনা ছিল গৌরীর, লিখেছেন তাঁর বন্ধু চন্দন গৌড়া যাঁর সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশ পেল একটি বই—As I See It: A Gauri Lankesh Reader।

    কলকাতায় গত ২৯ শে জানুয়ারি গৌরীর ৫৬ বছরের জন্মদিনে যে আলোচনাসভার আয়োজন করেছিলেন South Asian Women in Media (SAWM), সেখানে চন্দন গৌড়া বলেন যে তাঁর চেষ্টা ছিল বইটি যাতে গৌরীর আত্মজীবনীর মতো হয়ে ওঠে, শুধু প্রয়াত সাংবাদিকের নির্ভীক রাজনৈতিক লেখনীর সংকলন নয়। চলন্ত ট্রেনে দু-ঘন্টার যাত্রাপথে বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আমার মনে হচ্ছিল গৌরীর জীবনী-আত্মজীবনীর সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে গত কুড়ি-তিরিশ বছরের কর্ণাটকের সাধারণ মানুষের নানা প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাস—বিশেষ করে কুসংস্কার, বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বয়ান। এই বইয়ের সব লেখাই তাই একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ব্যক্তিগত/রাজনৈতিক, অন্দর-বহির্জগতের খাপ-খোপগুলোর প্রতি।

    গৌরীকে জানতে চেয়ে এভাবে দু-মলাটের মধ্যে কর্ণাটকের মানুষের প্রতিরোধের গল্পগুলো যদি না পেতাম, আর সেই সঙ্গে গৌরীকেও, তাহলে হয়তো কোনোদিনই আমার জানা হতো না ওখানকার সমকালীন প্রতিস্পর্ধার ইতিহাস। ২০০৩ সালে চিকমাগলুরে ‘বাবাবুদানস্বামী দরগা’ আক্রমণ রুখতে পথে নেমে কয়েকশো লোকের সঙ্গে গৌরীকেও জেলে যেতে হয়। সেখানে হাজার অসুবিধার মধ্যেও কি আনন্দে কেটেছিল দুটো দিন তার কৌতুকপূর্ণ বর্ণনা পাই গৌরীর নিজের কলমে। আর ওঁর সহযোদ্ধা ফণীরাজ-এর লেখায় পাওয়া যায় কর্ণাটক সম্প্রীতি মঞ্চ-এর কাজের কথা।  

    বলতে লজ্জা করছে, আমার জানা ছিল না ২০০২ সাল থেকেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিরুদ্ধে ওখানে Karnataka Communal Harmony Forum নামে একটি মঞ্চ লাগাতার কাজ করে চলেছে। হিন্দুত্ববাদী সেবকরা যখন চিকমাগলুরে মুসলিম-হিন্দু মানুষজনের মিলনক্ষেত্র ‘গুরু দত্তাত্রেয় বাবাবুদানস্বামী দরগা’ অধিগ্রহণ করে ‘দক্ষিণের অযোধ্যা’–য় পরিণত করতে তেড়েফুড়ে নেমে পড়েছিলেন, তখন কর্ণাটক সম্প্রীতি মঞ্চই সেটা আটকায়। এখনো ওই মঞ্চ সক্রিয় এবং এমন একটা রাজ্যের নানা জায়গায় কাজ করে চলেছে যেখানে দক্ষিণপন্থী রমরমা বহুদিনের।

    গৌরী-কেন্দ্রিক এই বইয়ে উঠে আসে তরুণ দলিত কবি প্রসাদের কথা, গৌরীর মা ইন্দিরা লঙ্কেশের লেখক হয়ে ওঠার গল্প। আসে তালেগুপ্পা গ্রামের চাষী-মেয়ে পূর্ণিমার কথা। যে পূর্ণিমা গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর, গৌরীর মৃত্যুর পরের দিন, বেঙ্গালুরু থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে নিজের গ্রামে একটা প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে প্রথমে বাজারের মাঝখানে এসে দাঁড়ান আর তারপর চলে যান ২১ কিলোমিটার পথ হেঁটে সবচেয়ে কাছের মহকুমা সদরে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানাতে। একা।

    পূর্ণিমার সঙ্গে আমার আলাপ হলো এই বইয়ের মাধ্যমে। যেভাবে কয়েক মাস আগে South Asian Women in Media (SAWM)-র একটি অনুষ্ঠানে মহিলা সাংবাদিকদের নিয়ে তৈরি ‘ভেলভেট রেভোলিউশন’ নামক তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে পরিচয় হয়েছিল রাফিদা বন্যা আহমেদ-এর সঙ্গে। যিনি নিজে গুরুতর আহত হয়েছিলেন যখন ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা ২০১৫ সালে ঢাকায় তাঁর স্বামী ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে। সেই বন্যা, যিনি মার্কিন দেশ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তক ব্লগারদের পাশে দাঁড়াতে। একা।

    একা এবং দলবদ্ধভাবে যাঁরা কাজ করছেন নানা বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে, তাঁদের আরো কয়েকজনের কাজের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল গত মাসেই গৌরীর জন্মদিনের কয়েক দিন আগে  ‘পিপলস ফিল্ম কালেকটিভ’-এর চলচ্চিত্র উৎসবে। কলকাতার এই উৎসবে গুজরাটের উনায় দলিত মেয়েদের জমির লড়াইয়ের ওপর ছবি ছিল; ছিল ‘আই অ্যাম হাদিয়া’-র মতো ছবি যেখানে অখিলার থেকে হাদিয়া হওয়ার কাহিনী মেয়েটির নিজের ও তাঁর স্বামীর ভাষ্যে আমাদের কাছে পৌঁছয়।

    ওই উৎসবে ‘চলচ্চিত্র অভিযান’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠীর ছবিও দেখা গেল, যাঁরা মিডিয়া কোঅপারেটিভ তৈরি করে উত্তরপ্রদেশের চারটি জেলায় কাজ করছেন। তাঁদের মুখপাত্র চলচ্চিত্রকার নকুল সিং সাহানির মুখে শুনলাম ওই জেলাগুলোর অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের তাঁরা শেখাচ্ছেন কীভাবে ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে নিজেদের এলাকা সম্পর্কে ছড়ানো ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়ো খবরকে প্রতিহত করা যায়। বিশেষ করে ওখানকার ‘ভীম আর্মি’-র ওপর আক্রমণ ও তাঁদের সম্পর্কে যে ধরনের কুৎসা ছড়ান ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, সেগুলো ভিডিওর মাধ্যমে কাউণ্টার করার কাজটাই করছেন ‘চলচ্চিত্র অভিযান’-এর স্বেচ্ছাসেবীরা। গৌরী দেখলে খুশী হতেন। শেষ যে সম্পাদকীয়টি তিনি লিখেছিলেন তাঁর ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’-র জন্যে, সেখানে ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়ো খবর ছড়ানোর ছকের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য ছিল।

    গৌরী কাজ করেছেন একা এবং দলবদ্ধভাবেও। তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল ‘দ্য ব্যাটেল অ্যাহেড’ বা ‘আগামীর সংগ্রাম’। এই প্রসঙ্গে Gauri Lankesh Reader-এ তাঁর বন্ধু রহমত তারিকেরে লিখেছেন, সামনের কঠিন লড়াইয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সমভাবাপন্ন মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, হাতে হাত রাখা। এটা নিয়ে আরো অনেক বেশি কথা হওয়া দরকার। পরস্পরকে কাছাকাছি আনার এই জরুরি কাজে কী South Asian Women in Media, কলকাতার ‘পিপলস ফিল্ম কালেকটিভ’ ও Karnataka Communal Harmony Forum-এর মতো গোষ্ঠীগুলো একত্র হতে পারে না?

     
     



    Tags
     



    Comments (2)
    • ধন্যবাদ, শঙ্করী। তুমি বইটা পড়ো, ভালো লাগবে। প্রকাশক Navayana. Online কিনতে পারবে মনে হয়।

    • খুব ভালো লাগলো..
      গৌরী লঙ্কেশ, পূর্ণিমা, রাফিদা,হাদিয়া সবার কথাই জানার ইচ্ছে হচ্ছে আরো l যদিও জানি সমুদ্রোচ্ছ্বাসের প্রত্যেকটি জলকণার আলাদা কোন পরিচয় হয় না আসলে l এঁরা সব এক l সংঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে তো সবাই ধীরে ধীরে….হবেই একদিন সবাই একসঙ্গে l আমাদের বিন্দু বিন্দু ত্যাগের যোগফল বিফলে যাওয়ার মত তুচ্ছ নয় l

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics