• অসীম আকাশ - শতবর্ষে বিজ্ঞানী অসীমা চ্যাটার্জী


    0    249

    October 17, 2017

     

    ১৯১৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। সেই হিসেবে এ বছরটা তাঁর জন্মশতবার্ষিকী। তিনি অসীমা চ্যাটার্জি, ভারতে রসায়ন বিজ্ঞানের এক পথিকৃৎ, যাঁর নাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বোস বা মেঘনাদ সাহার সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়। তাঁর বিজ্ঞান সাধনা দেখে মনে হয়, যে তিনিই ভারতের বিজ্ঞানচর্চার রেনেসাঁ যুগের শেষ প্রতিনিধি। জৈব-রসায়নের গবেষণায় তাঁর ভূমিকা ঐতিহাসিক। গবেষণার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন সেই সময়ে খানিকটা অবহেলিত বিষয়—ভারতীয় ওষধি, অর্থাৎ উদ্ভিদ, লতা, গুল্ম—যাদের কিছু না কিছু ভেষজ গুণ আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের থমকে যাওয়া পঠনপাঠন গবেষণার ধারাটিকে, সেই কারণে তিনি শুধু সাধারণ এক বিজ্ঞানী নন, এক মহান কালোত্তীর্ণ বিজ্ঞানসাধক।

    অসীমা যে সময়ে জন্মেছিলেন, সে সময় এবং তার অনেক অনেক পরেও ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েদের স্কুলে গিয়ে ফর্মাল এডুকেশন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারেও খুব গুরুত্ব পায়নি। যেকোনো অজুহাতে যখন তখন স্কুল ছাড়িয়ে বাড়িতে যেমন তেমন ভাবে পড়তে লিখতে শেখানোর ঘটনা আকছার ঘটত। অসীমার ১৭ বছর পরে ১৯৩৪ সালে লাহোরে জন্মানো বিখ্যাত পঞ্জাবি লেখিকা অজিত কউরের অভিজ্ঞতা যেমন—‘আমাদের বাড়িতে সব সিদ্ধান্ত দারজীই নিতেন। তাই মেয়ে স্কুলে যাবে না, এই সিদ্ধান্তও নিশ্চয় দারজীরই ছিল। স্কুলে গেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যায়।’

    ‘সে সময় আমার প্রত্যেক অপরাধের একটাই শাস্তি ছিল “স্কুলে যাওয়া বন্ধ”। স্কুল যেন চকোলেট। যেকোনো সময় ছিনিয়ে নেওয়া যায়। জসবীর (লেখিকার ভাই) যত দুষ্টুমি করুক না কেন, স্কুল ছাড়িয়ে দেবার ভয় ওকে কখনোই দেখানো হত না। কিন্ত আমায় স্কুলে পাঠানো আমাকে বিশেষ সুবিধে দেওয়া হত বলে মনে করা হত। এই সুবিধে পাবার জন্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জসবীরকে স্কুলে পাঠানো এই কারণেই জরুরী ছিল যে, তাকে লেখাপড়া শিখে দারজীর মতো ডাক্তার হতে হবে, পরিবারের নাম উজ্জ্বল করতে হবে। আর আমি তো বীজীর কথামতো “পরের গচ্ছিত ধন”। আমাকে অন্যের বাড়ি চলে যেতে হবে। লেখাপড়া শিখে আমি কি জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হব? রান্নাবান্না, ঘরসংসার এই তো আমার নিয়তি। এগুলো ভালভাবে শেখাই আমার পক্ষে জরুরী। এছাড়া মেয়েদের চালচলন কেমন হবে, কত নম্রভাবে কথা বলতে হয়, সবসময় চোখ নীচু করে রাখতে হয়, চিক তুলে বাইরে তাকানো নিষিদ্ধ, দুমদাম শব্দে সিঁড়ি দিয়ে নামা বারণ, ইত্যাদি ইত্যাদি।’

    তো বেশিরভাগ মেয়ের জন্যেই সমাজ বরাদ্দ করেছিল এরকম হেলাফেলার, জোড়াতাপ্পি দেওয়া পড়াশোনা, যে পড়াশোনা শিখে মেয়েরা কোনোরকমে নামসই করতে পারবে, প্রবাসী স্বামীকে ভুল বানানে চিঠি লিখতে পারবে, ধোপার হিসেব রাখতে পারবে। ব্যস। এর বেশি শিক্ষা মেয়েদের লাগে না। এরকম ভিত দিয়ে কোনো সাধারণ পেশা তৈরির কথা ভাবাই বাতুলতা, সে অবস্থায় বিজ্ঞানী হওয়া! কারণ বিজ্ঞানী হতে গেলে নূন্যতম একটা সহায়ক পরিবেশ লাগে। যেমন বলা যায় ডঃ লিলিবেন দেশাই, ডঃ শান্তা গান্ধী, ডঃ মালতী ভয়চোয়াল ওয়াংগিকরের কথা। এঁদের প্রত্যেকের বাবা ছিলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী। ছোট মেয়েরা যখন পুতুল নিয়ে খেলে তখন শান্তা গান্ধী বাঁধ ও সেতুর মডেল নিয়ে খেলেছেন। কিন্তু তেমন উদাহরণ আর ক’টা? ধরা যাক বিখ্যাত জৈব-রসায়নবিদ শান্তু গুরনানির কথা। তাঁর শৈশব কাটে করাচিতে। রক্ষণশীল পরিবারে তাঁকে চতুর্থ শ্রেণীর ওপর পড়তে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করেনি। ১৯৩২ সাল থেকে কাগজে অনেক আবিষ্কারের খবর ছাপা হতে থাকে। মেয়েটি পড়ত আর ভাবত ‘আমার বাবা যদি আমাকে স্কুলে পাঠাত তো আমিও কিছু আবিষ্কার করতে পারতাম।’ তার খুব চিন্তা হত যে তার যখন সময় আসবে তখন আর আবিষ্কারের মতো কিছু বাকি থাকবে না। মেয়েটি কিন্তু হাল ছাড়েনি, যখন যেটুকু শেখার সুযোগ পেয়েছে, কাজে লাগিয়েছে, সে লাঠি বা তরোয়াল চালানো হোক, কিংবা সেলাই শেখা বা হিন্দি শেখাই হোক। তার জন্যে সে রাস্তার আলোয় বসেও পড়েছে, বই ধার করেছে এর ওর তার কাছ থেকে। দেশভাগের পর তারা চলে আসে বম্বে, সেখানে বাইশ বছরের মেয়েটি ছোট ভাইকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে কিছু করার সুযোগ খুঁজত। হঠাৎ সে একদিন কী ভেবে চিঠি লিখে বসল সেইসময়ের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে, আর কী আশ্চর্য, নেহরু তাকে তিনটি কলেজে ভর্তির ফর্ম পাঠিয়ে দিলেন। ১৯৪৮ সালে একটি কলেজে ভর্তি হল সে, সেই তার নিয়মিত ছাত্রীজীবনের শুরু, যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

    না, অসীমা চ্যাটার্জির জীবনের শুরুটা সে তুলনায় অনেক মসৃণ। কারণ তিনি পিতা হিসেবে পেয়েছিলেন ডঃ ইন্দ্রনারায়ণ মুখার্জিকে, উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে যাঁর ছিল প্রচুর আগ্রহ। সম্ভবত অসীমা ভেষজ উদ্ভিদের আগ্রহ তাঁর পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। বেথুন স্কুলে শিক্ষারম্ভ। তারপর বেথুন কলেজ, স্কটিশ চার্চ কলেজ। ১৯৪৪ সালে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ। নাগার্জুন পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক, প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি, মোয়াট স্বর্ণপদক ইত্যাদি আরও পুরস্কারে সম্মানিত অসীমার মধ্যে কোথাও ছিল ভারতীয় যোগীর মতো সুখে দুঃখে বিগতস্পৃহা এবং নিজের কাজে অবিচল নিষ্ঠা। খ্যাতি, পুরস্কার কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে অবৈতনিক লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এরপর এগারো মাসের শিশুকন্যা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দেন। এটিও তাঁর চরিত্রের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। ঘর ও বাইরেকে তিনি সমান যত্নে সামলেছেন। তাঁর সেই কন্যা পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিজ্ঞানী জুলি ব্যানার্জী।

    বিদেশ থেকে ফিরে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভেষজ উদ্ভিদের গবেষণায়। তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল মৃগী ও ম্যালেরিয়ানাশক দুটি অনন্য ওষুধ। এছাড়াও Vinca Alkaloid-এর ওপর কাজ করে তিনি আবিষ্কার করেন এর ক্যান্সার-প্রতিরোধক গুণ। কোষ বিভাজনের বিরুদ্ধে কাজ করার ক্ষমতা থাকায় এটি কেমোথেরাপিতে ব্যবহৃত হয়।

    প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার, ভারতীয় সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে উইম্যান অব দা ইয়ার, পদ্মভূষণ, রাজ্যসভার সদস্য—এসবের কোনো কিছুই তাঁর সাধনা থেকে তাঁকে টলাতে পারেনি। তাঁর একটাই কথা ‘আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন কাজ করতে চাই’। পার্লামেন্টে বিশেষ মুখ খোলেন না কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘কারণ আমি কথা বলার চেয়ে কাজ করতেই বেশি ভালবাসি। তাছাড়া এখনকার নেতারা তো আমাদের কথা বিশেষ শুনতে চান না’।

    অসীমা পাশে পেয়েছিলেন স্বামী অধ্যাপক বরদানন্দ চ্যাটার্জিকে, যিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা ভৌত- রসায়নবিদ।

    তাঁর একটি চিরস্মরণীয় কাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ভারতীয় বনৌষধি গ্রন্থ সম্পাদনা। বহু দেশ ঘুরেছেন, ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতে আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর একটা গভীর অন্তরজগৎ ছিল। রমেন মজুমদারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি যখন অসুবিধায় পড়ি, আমার সামনে যখন সঙ্কট উপস্থিত হয়—তখন আমি একটা নির্দেশ পাই। আমি মনে করি, সেই নির্দেশ ওপর থেকে আসে। ঐ যে অন্তর্নিহিত শক্তির কথা বলেছি, যার সঙ্গে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের যোগাযোগ আছে, সেই শক্তির মাধ্যমেই আমার কাছে নির্দেশ আসে। ব্যক্তিগত সমস্যায় যেমন আসে, গবেষণার ক্ষেত্রে সমস্যায়ও তেমনি আসে’।

    সরোজকুমার রায় যথার্থ বলেছেন, ‘অসীমা চ্যাটার্জি ছিলেন এক ঐতিহাসিক চরিত্র যিনি ভারতীয় রসায়নের একটি শতাব্দীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন, ভারতীয় জৈব-রসায়নের গবেষণার স্বর্ণসম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছেন।’

    শতবর্ষে এই মহান বিজ্ঞানীকে প্রণাম।

     

    তথ্যসূত্র-

    ১। উদ্ভিদ, লতা, গুল্মের রসায়ন ও একজন নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী- অধ্যাপিকা অসীমা চ্যাটার্জি, সরোজ কুমার রায়, এ যুগের কিশোর বিজ্ঞানী, ভারতের মহিলা বিজ্ঞানী সংখ্যা, মে-জুন ২০১৬

    ২। বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ঈশ্বর, রমেন মজুমদার, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, ডিসেম্বর ১৯৯২  

     

     
     



    Tags
     


    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics