• সুন্দরবনের যাত্রামঞ্চ থেকে কলকাতার গার্হস্থ্য শ্রমিক : সুলতা মাঝি


    1    196

    February 9, 2018

     

    সুলতা মাঝি নামটির সাথে পরিচিত হই সুন্দরবন পর্বে ‘সুন্দরবন বিজয়নগর দিশা’ ও ‘এবং আলাপ’-এর উদ্যোগে যে নতুন মৌখিক ইতিহাসের রচনার প্রাথমিক পর্ব চলছিল সেই সময়ে। সুলতা মাঝি সুন্দরবনের নারীদের এক অন্যধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে জানতে পারি। তিনি একজন শিল্পী; কিশোরী বয়স থেকে যাত্রাদলে অভিনয় করছেন। সুন্দরবনের বালি দ্বীপে একজন কিশোরীর যাত্রাদলে অভিনয়, বড় হয়ে ওঠা, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সম্মন্ধে শোনার পর তাঁর অন্যধারার লড়াইকে জানতে চাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হতে শুরু করে। যদিও সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি ওই পর্বে। কারণ যে সময়ে দিশার সাথে আমরা এই আলাপপর্বের কাজ শুরু করি, সে সময়ে জানতে পারি সুলতা মাঝি গ্রামে নেই। তিনি শহরে চলে এসেছেন কাজের সন্ধানে। যাত্রা ছেড়ে তিনি অন্যভাবে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজতে শহরের গৃহশ্রমিকের কাজ করতে চলে গেছেন।

    কিন্তু সুলতা মাঝির যাত্রায় অভিনয়ের সাথে তাঁর সুন্দরবনের জীবনযাত্রার যে ভিন্নধারার লড়াই, সেটা জানবার প্রবল ইচ্ছে আমাদের মনে থেকে যায়। এ কারণে শর্মিষ্ঠাদি, চেষ্টা করলেন সুলতা মাঝিকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় তার। শর্মিষ্ঠাদি ও দিশার মেয়েদের উদ্যোগে সুলতাদির ফোন নাম্বার খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি কথা বলতে ইচ্ছুক কিনা সে বিষয়ে তাঁকে ফোন করে জানতে চাওয়া হলে তিনি খুবই উৎসাহের সাথে আমাদের সাথে কথা বলবেন বলে জানান। সুলতাদি যে বাড়িতে কাজ করেন সেখানকার ঠিকানা তিনি পাঠান এবং আলাপ-এর অফিসে। কিন্তু সেখানে ইন্টারভিউ নেওয়া সম্ভবপর হয় না। অবশেষে যে সমাধানটা পাওয়া যায় সেটা হল এবং আলাপ-এর অফিসে বসে সুলতাদির সাথে কথা বলা হবে। সুলতাদি সানন্দে রাজী হলেন এবং সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখ, ২০১৭ তারিখে শর্মিষ্ঠাদির সাথে এক সু-দীর্ঘ কথোপকথনের মধ্যে বড় হওয়া, যাত্রার মধ্যে এসে যাত্রাকে ভালোবেসে এক নতুন জীবন বাছা, সব কিছুর শেষে বেঁচে থাকার তাগিদে এক পরিযায়ী জীবনকে বেছে নেওয়া আর ছেলে, মেয়ে ও নিজের একটা পরিযায়ী সংসার যেখানে উনি কোলকাতা শহরে, ছেলে ও মেয়ে ভিন রাজ্যে—এই সবকিছুই খোলা মনে তুলে ধরলেন চোখের সামনে।  

    শর্মিষ্ঠাদির সাথে কথোপকথনকালে যে সুলতা মাঝিকে আমরা দেখি তাঁকে দু’ভাবে বর্ণনা করা যা—এক শিল্পী সুলতা মাঝি এবং অন্যজন মহিলা পরিযায়ী শ্রমিক সুলতা মাঝি। আমরা তাঁর জীবনের দুটো পর্যায়কে তাঁর ভাষাতেই খানিকটা জানি চলুন।

    শ.দ. – সুলতা, প্রথমে যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করি যে তুমি কবে কলকাতায় এলে, কতদিন হল কলকাতায় তুমি আছ?

    সু.মা. – সেপ্টেম্বর মাসে এসেছি, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে। ২০১৬ সালে। 

    শ.দ. – তার আগে কোনোদিন কলকাতায় আসোনি?

    সু.মা. – হ্যাঁ তার আগে একবার কলকাতায় এসেছিলাম। আমার স্বামীর অত্যাচার করে আমার পা ভেঙে দিয়েছিল। তখনও আমার বাচ্চা হয়নি। তো তখন একবার কলকাতায় কাজ করে গেছি।

    শ.দ. – সেটা অনেক বছর আগে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। সেটা বেহালাতে।

    শ.দ. – আচ্ছা। তখন কিছুদিন করেছিলে। আবার এই গত এক বছর...

    সু.মা. – উনি আমাকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসে, আমাকে সুন্দরভাবে রেখেছিলেন, প্রথম প্রথম সুন্দরভাবে, তারপর থেকে মদ, গাঁজা মানে আমার প্রতি ভীষণ একটা টর্চার শুরু করল, এবং আমার প্রতি সন্দেহ করতে শুরু করল, যে আমি যাত্রায় অভিনয় করি, যে আমি আমার চেহারাটাকে বেশ সুন্দর তৈরি করে ফেলেছিলাম, যার জন্য ওনার হিংসা বেড়ে গিয়েছিল, অথচ উনি গানও গাইত, তো আমি বুঝিয়েছিলাম, যে তুমি একজন গায়ক, মানে গান অর্থাৎ জ্ঞান, সমস্ত অডিয়েন্সকে তুমি জ্ঞান দিয়ে আসো, তাহলে তুমি কি করে একজন শিল্পী হয়ে একজন শিল্পীর প্রতি এতটা ঘৃণা করতে পারো, এত জঘন্য কথা বলতে পারো? আমি বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী সেটা বোঝেনি। মদফদ খেয়ে হ্যানত্যান করে, আমাকে খুব টর্চারিং করত, আমি তাই পালিয়ে চলে এসেছিলাম।

    শ.দ. – তখন এই  চিকিৎসা কোথায় করিয়েছিলে?

    সু.মা. – গোসাবা হসপিটাল।

    শ.দ. – গোসাবা? সরকারী হাসপাতালে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। পাশে গ্রাম্য ডাক্তার একজন, দিলীপ অধিকারী, উনি আমাকে এই সামান্য, যাতে হাতটার কিছু না হয়, তাই প্লাস্টার করে দিয়েছিল। তারপর আমি এসেছিলাম ক্যানিং-এর কি যেন...

    শ.দ. – বাসন্তীতে?

    সু.মা. – না না বাসন্তী পেরিয়ে আরও, মানে সোনাখালি পেরিয়ে আরও...

    শ.দ. – সরবেড়িয়া?

    সু.মা. – সরবেড়িয়া। ওখানে...

    শ.দ. – ওখানে যে হাসপাতালটা আছে, শ্রমজীবী হাসপাতাল?

    সু.মা. – ওখানে হাত প্লাস্টার করে, ওখানে ওনারা একটা জাব বসিয়ে দিল আমার হাতে, তারপর বলেছিল পনের দিনের পর আসবে। আরেকটা মালিশ দেব আর একটা ঘি দেব। আমাকে আসতেও দেয়নি আর আমাকে সেভাবে সুস্থও হতে দেয়নি। হাতটা বেঁকে গেল। সেইভাবে আমি নদীতে জালফাল টেনে, হ্যানত্যান করে...

    শ.দ. – আচ্ছা। তো তখন একবার বেহালায় এসে কিছুদিন কাজ করেছিলে? কারোর বাড়িতে?

    সু.মা. – হুম, হুম।

    শ.দ. – আর তারপর এক বছর হল আবার এসে...

    সু.মা. – আবার এসেছি...

    শ.দ. – আরেক জায়গায় কাজ করছ।

    সু.মা. – তার মানে বাচ্চাকাচ্চা অত বড় হয়ে গেল। আমি টিউশনিই করতাম।

    শ.দ. – তোমার কটি বাচ্চা?

    সু.মা. – আমার দুটি বাচ্চা। একটি ছেলে একটি মেয়ে।

    শ.দ. – তা কত বছর বয়সে তুমি বিয়ে করো?

    সু.মা. – আমি জাস্ট চোদ্দ বছর, খাঁটি চোদ্দ বছর। আমি তখন বিয়ে করতাম না। পড়াশুনা চলাকালীনই আমার যাত্রা চলেছিল।

    শ.দ. – কিন্তু এনার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর... তোমার স্বামীর নামটা?

    সু.মা. – কমল মাঝি।

    শ.দ. – কমল মাঝির সাথে তোমার চোদ্দ বছরে বিয়ে হয়, তারপর থেকে তুমি বিরাজনগরে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। 

    শ.দ. – তোমার বাবা কি করতেন?

    সু.মা. – আমার বাবা ডিলারের কাজ করত। চাল, চিনি।

    শ.দ. – আচ্ছা।

    সু.মা. – এখন আমার বড়দা করেন। সূর্যকান্ত মণ্ডল।

    শ.দ. – তা তোমাদের অবস্থা মোটামুটি ঠিক ছিল? 

    সু.মা. – আমার বাবারা চার ভাই, ছত্রিশ বিঘে জমি। আমি জমিদার বংশের মেয়ে। কিন্তু আমি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে ফেললাম। আমার তখন ন’ বছর বয়স। মা ছিলেন, আর দাদারা।

    শ.দ. – কোথায় পড়লে? কোন স্কুলে?

    সু.মা. – আমি ছোট মোল্লাখালি গৌরিপুর হাই স্কুলে পড়েছিলাম। ওখানে টেন পর্যন্ত আছে। আমি টেন পর্যন্ত যেতে পারিনি। আমি ক্লাস নাইনে সবে ভর্তি হয়েছিলাম।

    শ.দ. – তারপরেই তোমার বিয়ে হয়।

    সু.মা. – হ্যাঁ।

    শ.দ. – তো তোমাকে পড়ানো হয়েছিল যতদুর তুমি চেয়েছিলে? তো তুমি যে স্কুলে যেতে, তোমার ভালো লাগত?

    সু.মা. – আমার খুব ভালো লাগত খেলাধুলা করতে।

    শ.দ. – আর কি ভালো লাগত?

    সু.মা. –  হুম..., তারপর মাখনবাবু একদিন বললেন আমাদের দিদিমনিদের একটা বই ধরেছি, তা ক্লাসের মেয়েরা কে কে করতে আগ্রহী, তারা হাত তোলো। তা আমি প্রথমেই হাত তুলেছিলাম, যে আমি ওই নাটক করব। তা বলেছিল তুমি পারবে? আমি বলেছিলাম হ্যাঁ স্যার। আপনি যেখানে ড্রেসমাস্টার আমি সেখানে নিশ্চই পারব। স্যার বললেন ঠিক আছে। তো আমি বললাম স্যার কবে কবে যাব? তো বললেন তুমি প্রতিদিন বিকেলবেলা করে যাবে। তখন বৈশাখ মাসের বিকেলে প্রতিদিন, সকালে ছুটি ছিল...

    শ.দ. – তা কোথায় রিহার্সাল হত? মাখনবাবুর বাড়িতে?

    সু.মা. – না বাড়িতে না, একজন দিদিমনির, ওই যে বালকদের স্কুল বলে না, সেই বালবাড়িতে হত... ছোট মোল্লাখালিতে, এই পাড়া থেকে ওই পাড়া, তো যাই হোক, ওখানে আমরা চলে যেতাম, এবং ওই স্কুলের মেয়েরা, অন্যান্য ইস্কুলের মেয়েরা সবাই আসত ওখানে শিখতে, আমাদের তপতীদি, নীলিমাদি এঁরা শেখাতেন।

    শ.দ. – কি নাটক করেছিলে?

    সু.মা. – আমি ওখানে প্রথম নাটক করেছিলাম ‘গরীবের সংসার’।

    শ.দ. – কার লেখা গো? মনে আছে?

    সু.মা. – অগ্রদূতের।

    শ.দ. – আর তারপর আরও নাটক করেছ?

    সু.মা. – হ্যাঁ তারপর আরও নাটক করেছিলাম। অগ্রদূতের। তারপর মাখনবাবুকে একজন ধরল, মাখনবাবুর ওই পাড়াতে, যে একটা রোল করে দেবার একটা মেয়ে পাওয়া যাবে স্যার? তা বলল, কিরকম? না একটু নাচবে, আর গান যদি নাও গাইতে পারে, ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে গেয়ে দেব, একটা বাইজি করতে হবে। তা বলল আছে। কে, না সুলতা মণ্ডল। বলল ও কি পারবে। না ও আমাদের অনেক নাটক করেছে, খুব সুন্দর করে। তো উনি যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। তো সেই বইটার নাম হল ‘সূর্যমুখীর সংসার’।

    শ.দ. – যাত্রা?

    সু.মা. – হ্যাঁ।

    শ.দ. – তো এই প্রথম তুমি যাত্রায় যোগ দিলে?

    সু.মা. – আমি ‘বিপাশার’ অভিনয় করলাম সেখানে। ছোট মোল্লাখালি কালিদাসপুর হয়েছিল? তখন ক্লাস ফাইভে।

    শ.দ. – তোমার বাড়ি থেকে আপত্তি করেনি?

    সু.মা. – হ্যাঁ আমার মা খুব বাধা দিত। মা মেজদাকে বলত। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যেতাম।

    শ.দ. – মা কি বলতেন?

    সু.মা. – মা বলত, যে পড়াশুনা বন্ধ করে এইসব করা হচ্ছে? নাটক নকল করা হচ্ছে? নাচগান করা হচ্ছে? মেজদা জানতে পারলে তোকে খুব মারবে। আমি বলি, মা, আমি মানুষকে কথা দিয়েছি না? সবাই আমাকে ভালবাসে। আমার নাটক শুনেছে, তোমরা যাওনি, তোমরা কি বুঝবে? বাইরে তো যাও না, বাইরের হাওয়াও তোমাদের মধ্যে নেই। তাই তোমরা বুঝতে পার না। আমাকে সবাই ভালো বলেছে। আমি নাটকে ভালো করেছি। আমাকে সবাই ভালো বলেছে। তাই ওরা একটা যাত্রাবই খুলেছে, আমাকে নেবে মা। আমি তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ মাগো, মামণি, তুমি আমাকে বাধা দিও না। মা বলল, ঠিক আছে তুই লুকিয়ে লুকিয়ে যাবি, খুব তাড়াতাড়ি এসে আবার কিন্তু পড়তে বসবি।

    শ.দ. – দাদারা আপত্তি করত না?

    সু.মা. – হ্যাঁ দাদারা তো পড়াকালীন ওগুলো করতে দিত না। মেজদাই বেশিরভাগ গার্ড দিতেন, পড়াশুনার দিক দিয়ে। আর সেজদা মানে স্কুলের ড্রেস বইপত্তর এনে দিতেন, আর মেজদা গার্ড দিতেন, প্রশান্ত মণ্ডল। 

    শ.দ. – তো ওই যে যাত্রা হল, অভিনয় করলে, বাড়ি থেকে কেউ দেখতে গিয়েছিল?

    সু.মা. – মা, কাকিমারা যেতেন না। দিদিরা যেতেন, দাদারা যেতেন। মানে কাকার ছেলেরা, এরাই যেতেন। আমার নিজের দাদারাও যেত না। যদিও যেত, বড় বড় কোনও অপেরা বা দল যদি আসত, সঙ্গে করে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসত। একা ছাড়ত না কখনও।

    শ.দ. – তুমি যে দলের হয়ে ‘সূর্যমুখীর সংসার’ করছিলে, সেটা কাদের গ্রুপ ছিল? এই পালাটা? কোন কোম্পানি?

    সু.মা. – ওইটা ছিল বানিখালি? ছোট মোল্লাখালির বানিখালি স্কুলের, একটা ক্লাব থেকে হয়েছিল।

    ‘দেশঘরে’ আমি নাম লিখিয়ে এসেছিলাম। এগ্রিমেন্ট করে এসেছিলাম। আমার নিজের মতে। কারোর মতে আমি করিনি। এই অভিনয় জগতটা আমার ওইদিন থেকে খুব ভালো লেগেছিল। এবং অডিয়েন্স দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল।

    শ.দ. – অডিয়েন্সে কিরকম লোক থাকত? মনে আছে?

    সু.মা. – প্রচুর প্রচুর। মানে তখন তো দু টাকা তিন টাকার টিকিট ছিল।

    শ.দ. – গ্রামের যাত্রায় কি তখন মেয়েরা আসত দেখতে?

    সু.মা. – হ্যাঁ হ্যাঁ।

    শ.দ. – মানে তুমি যখন অভিনয় করতে, দেখতে পেতে মেয়েরা বসে আছে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। অনেক দূর থেকে। আর আমাকে বলত যে, কোথায় যাত্রা করবে? বললাম ওইখানটা। বলে যাব তাহলে তোর যাত্রা শুনব, তোর গান শুনব। তুই কেমন করিস দেখতে যাব। আমি বলি, তোরা কোন সাইডে বসবি? বলে, আমরা ঠিক তোর ডান সাইডে সামনাসামনি একদম ডান সাইডে বসব...

    শ.দ. – এটা কারা বলত? তোমার বন্ধুরা?

    সু.মা. – আমার দিদিরা। আর ইস্কুলের বন্ধুরা, গার্লফ্রেন্ডরা, ওরাও যেত, আমি যখন স্কুলে যেতাম, তখন বলত, তুই কি ভালো অভিনয় করেছিস।

    শ.দ. – ও তোমার বন্ধুরাও যেত তোমার যাত্রাপালা দেখতে?

    সু.মা. – হ্যাঁ কাছাকাছি কোথাও হলে যেত, আর এসে আমাকে বলত। নিবেদিতা, সুভাষী, কল্যাণী, বুলু। এরা বলত আমাকে, সুলতা, তুই কি ভালো অভিনয় করলি ওখানে, তুই নাটকের থেকেও ভালো করলি ওখানে। আমি বলি, ধ্যাত, আমি একদম ভালো করিনি। কে বলেছে রে? না রে সত্যিই ভালো হয়েছে।

    শ.দ. – তো তোমার তো স্কুলে ছেলেরাও ছিল মেয়েরাও ছিল

    সু.মা. -  হ্যাঁ।

    শ.দ. – তা স্কুলের ছেলেরা তোমার যাত্রা দেখতে যেত না?

    সু.মা. -  আমি জানি না, তবে ওরা আমাকে বলত যে তোর যাত্রা দেখেছি, তোর যাত্রা শুনেছি, আমি কিন্তু অতটা বিশ্বাস করতাম না। ওরা বলত, তুই এইখানে গিয়ে গ্রিনরুমে এইখানে গিয়ে বসে সাজছিলিস, মুখে পেন্ট করছিলিস, আমরা দেখেছি। এটাই বলত। আমি ওদের দেখিনি।

    শ.দ. – কিন্তু তুমি তারপর যখন স্কুলে ফেরত যেতে, ধরো যাত্রার শো হয়েছে, দু’ দিন বাদে আবার স্কুলে যাচ্ছ, ক্লাস হচ্ছে, তখন ছেলেরা তোমাকে কি বলত? তোমার পিছনে লাগত না?

    সু.মা. – না না। আমাকে ভালো বলত। ছেলেরা খেলাধুলা, ব্যায়ামের দিক দিয়ে সব দিক দিয়ে আমাকে খুব ভালো বলত। এবং স্কুলে আমার নাম দিয়েছিল পাতাসি। আমি খুব রোগা ছিলাম। খুব ছুটতে পারতাম। তাই আমার নাম দিয়েছিল ছেলেরা ওরকম।

    শ.দ. – বাতাসী নয়, পাতাসি?

    সু.মা. – হ্যাঁ। ঝড়ের বেগে যেমন ছুটবে, তেমনি ঝড়ের বেগে অভিনয় করে।

    শ.দ. – বাহ।

    সু.মা. – আমার সবচেয়ে এই অভিনয় জগতটাই ভালো লেগেছিল। আমার সবচেয়ে আকর্ষণ করত এই অভিনয়। অনেকে বাহবাটা দিত বলে আমাকে আরও মনটা টেনে চলে গেল যে তাহলে সবাই যখন ভালো বলছে তখন নিশ্চই আমি একদিন ভালো হব বা বড় হতে পারব। বা বড় জায়গায় চলে যেতে পারব। তাই এই অভিনয় জগতটা আমার, এই প্রতিভা জেগে গেছিল...

    শ.দ. – তোমার মত মেয়েরা, বা তোমার চেয়ে একটু বড় মেয়েরা, তারা কি তখন গ্রামের দিকে যাত্রাপালায় অভিনয় করত?

    সু.মা. – হ্যাঁ আমার আগে অনেক দিদিরা যাত্রাপালা করেছে, আমি যখন দু নম্বর ছোট মোল্লাখালিতে সারদাবাবুর ড্রেসঘরে আমি যখন এগ্রিমেন্ট করতে যাই, তখন দেখি আমার বড় বড় দিদিরা আছে, বিভিন্ন জায়গার, কেউ ছোট মোল্লাখালি দু নম্বরের, কেউ... (চুপ)

    শ.দ. – আচ্ছা, এই যে অভিনয় করতে, এত ছোট বয়স থেকে, তখন থেকে কি কিছু পয়সা পেতে, অভিনয় করে?

    সু.মা. – হ্যাঁ তখন অল্প পয়সা দিত। ড্রেসঘর থেকে আশি টাকা দিত। আর ওরা কুড়ি টাকা করে কাটত।

    শ.দ. –তারপর?  

    সু.মা. – সেলাই। বিভিন্নধরনের সেলাইয়ের কাজ জানি। তো যাই হোক, আমি স্কুলও করতাম, যাত্রাও করতাম, খেলাধুলাও করতাম। তারপর আমার যখন স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, খেলাধুলাও বন্ধ হয়ে গেল।

    ... আমি একটা গল্পের বই উপহার পেয়েছিলাম স্কুল থেকে, ‘এযুগের দুঃশাসন’। কার লেখা ছিল আমার মনে নেই। যাই হোক, বইটা এতটা মোটা, বেশ সুন্দর বই। তো সবাই নিয়ে পড়তে শুরু করল এবং বইটা যে কে নিয়ে নিল, আর আমাকে দিল না।

    শ.দ. – আচ্ছা। তুমি নিজে পড়েছিলে?

    সু.মা. – আমি নিজে পড়েছিলাম। পড়ে নিয়ে আমি রেখেছিলাম। তখন বলল তুই স্কুল থেকে যে একটা বই উপহার পেলি, সে বলল আমাকে একটু দে, আমাকে পড়তে হবে। কিন্তু আমি বললাম, দু তিন দিনের মধ্যে পড়ে কমপ্লিট করে, আমাকে কিন্তু ফেরত দিবি। আমার বইটা খুব প্রিয় বই। গল্পের বই, আর স্যার নিজে হাতে করে আমাকে দিয়েছেন। ওনার স্মৃতি আমাকে রাখতেই হবে। এখন সেই বইটা যে কে নিয়েছিল আমি জানি না।

    শ.দ.- তারপর?

    সু.মা. – দাদারা সবাই আলাদা হয়ে গেলেন। এবং মার ছাগল ছিল। অনেক হাঁস মুরগি ছিল। তা থেকে চলত এবং ঘরের জমি, ধান ছিল। সেগুলো কিনতে হত না। আনাজ ছিল বাড়ির, কিনতে হত না। অনেক নারকেল গাছ, অনেক সুপারি গাছ, সেসব আমাদের কিনতে হয় না। তো যাই হোক, তা খুব অল্প পয়সা হত, মাকে দিতাম, এবং আমি সেলাই শেখার জন্য উল-টুল কিনতাম, এবং নিজের ব্লাশটার জন্য অনেককিছু কিনতাম, মাও নিজে কিনে দিতেন, মুখে মাখার, পেন্ট করতে, টোয়েন্টই ফোরে পেন্ট তুললে কোনটা দিলে মুখে ব্রণ হবে না, মুখে দাগ আসবে না, এরকম জিনিসগুলো কিনতে... এইভাবে চলত আমার। তারপরে, আমি ন’ নম্বর শান্তিগাছিতে বই করতে গেলাম, বিষ্ণুবাবুর কালভোমরা, বিষ্ণুবাবুর নিজের হাতে লেখা বই, কালভোমরা। তো সেই দিনের দিনে সেইখানে ওনার সঙ্গে দেখা হয়, আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে।

    শ.দ. – কমল মাঝি?

    সু.মা. – হ্যাঁ। এবং উনি গান করতে গেছিলেন ওখানে। উনি অভিনয় করতেন, ওই গানের মধ্যে যেটুকু অভিনয় সেটুকুই করতেন। তাছাড়া উনি সবসময় বিবেকেই করতেন। তো যাই হোক, ওনার সঙ্গে ওই পরিচয় হয়ে, তো বলল, তোমার আর কোথাও গান আছে? আমি বললাম হ্যাঁ, আমাদের ওখানে গান আছে, ছোট মোল্লাখালি আট নম্বরে গান আছে। তো বললে, আমিও যাব। চলো। ওইখান থেকে ভালো পরিচয় হতে হতে, আমি বললাম, দুপুরবেলা তো, সন্ধেবেলা গান, তাহলে বাড়িতে চলো, বাড়িতে মা আছেন, গিয়ে মাকে বলি, আমার দুটো বন্ধু এসেছে, বয়ফ্রেন্ড একটা গার্লফ্রেন্ড, তুমি কিছু খাওয়ার আয়োজন করো। গিয়ে দেখি মা আর নেই। ছোট ভাইটাই ছিল। তা ছোট ভাই বলল, ছোড়দি, তুই কর। আর দিদি, দাদাকে খেতে দে। তো আমার সেই গানের গায়ক আর গায়িকারা গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে দুপুরবেলা, খাওয়াদাওয়া করে সন্ধেবেলা গান করলেন। ওনার কি ভালো লেগেছিল জানি না, উনি বললেন আমাদের বাড়ি যেতে হবে। আমি বললাম না, ওভাবে আমাকে নিয়ে গেলে তো আমি জানি না, যদি কোনও গানের শো থাকে তাহলে আমি যাব। নইলে আমি যাব না, আর কেউ না নিয়ে গেলে আমি কারোর বাড়ি যাই না। এটাই প্রথম থেকে শেষ অবধি আমার থেকে গেছে। উনি আমাকে এসে নিয়ে গেলেন গানের সোর্স দেখিয়ে।

    সেই বলে নিয়ে গেলেন। গিয়ে বললেন আমি তোমাকে গানের শো দেখিয়ে নিয়ে এসেছি, আমি তোমাকে বিয়েই করব।

    শ.দ. – বিরাজনগরে?

    সু.মা. – ওনার বাড়িতেই, পুরো বাড়িতেই তুলে নিয়েছেন, ঘরেতেই ঢুকিয়ে নিয়েছেন।

    বলল তোমারও তো সংসার করতে হবে। তোমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। তো আমি বলি, আমাকে কিন্তু যাত্রা করতে দিতে হবে। আমায় গান করতে দিতে হবে। গান আমার প্রিয় জিনিস। আমি যতদিন বাঁচব, যতদিন আমাকে সাথে চাইবে ততদিন আমাকে গান করতে দিতে হবে, যেদিন দেখব পার্টি আমাকে চাইছে না, সেদিন থেকে আমি বসে যাব। তা বলে হ্যাঁ। তো উনি আর আমি করতাম।

    শ.দ. – একসাথে? 

    সু.মা. – হ্যাঁ।

    শ.দ. – তো তখন বিয়ে করলে ওনাকে?

    সু.মা. – হ্যাঁ করে নিলাম। বাপের বাড়িতে না জানিয়ে। আমি নিজে করে তারপরে, মাস দুই পরে, মানে পুজার কাছাকাছিতে আমি গিয়ে উঠলাম। মা বলল কি ব্যাপার? বললাম মা এরকম একটা কাজ করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দাও। তোমাদের কিছু বলিনি আমি। তো ছেলেটা খুব ভালো। কোথায় সে ছেলে? বলি এসেছে। বলে ডাক। মা যত্ন করল। সবাই ভালো বলল। সুন্দর দেখতে। ভালো ছেলে।

    তারপর একসাথে  দুজনে যাত্রাপালা করা শুরু আতাপুর, মনিপুর, সন্দেশখালি, মানে বিভিন্ন জায়গায়, আমাদের ওদিকে, কুমিরমারি...

    শ.দ. – আচ্ছা।

    সু.মা. – হ্যাঁ। তার মাঝখানে উনি আমার, মানে ওনার বাপের বাড়ির ধারে, আমার শ্বশুরবাড়ি, কাছে উনি গান করলেন এক নাইট, তা সেই বইটাতে আমাকেও নিতে চেয়েছিল...

    শ.দ. – ওই বিরাজনগরে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। তা আমাকে করতে দেয়নি উনি। তা বলছে, সবাই জানে যখন, যে তুই গান করা মেয়ে নিয়েছিস, এবং গানও করে, সবাই তো দেখেছে, গোসাবা থানাতে কম্পিটিশনে গান করেছি, সবাই দেখেছে, তাহল এখানে করতে কি অসুবিধা? না বাবা আছে, বাবা-মা রয়েছে...

    শ.দ. – তখন তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি ছিলেন?

    সু.মা. – তারা কি বলবে? বলি তারা কিছু বলবে না। আমাকে রোলের খাতা এনে দাও, আমি ঠিক দিনের দিনে গান করে চলে আসব। আমাকে করতে দেয়নি, সেদিন থেকে আমার মনের মধ্যে একটা রাগ জন্মে গিয়েছিল। আর উনি করেছিলেন, কিন্তু আমি বলেছিলাম, তুমি নেশা করবে না। নেশা করে তুমি কখনও এই প্যাথেটিক গান গাইবে না। গাইতে তুমি পারবে না। যেদিন থেকে তুমি ওই গান নেশা করে করবে, সেদিন থেকে তোমার গান ভালো হবে না, এবং তোমাকে আর কেউ ডাকবে না। সেদিন থেকে তুমি বসে যাবে। আমি কিন্তু আমারটা চালিয়ে যাব। যেখান হোক। তো যাই হোক, উনি সেই জেদটা আমার ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। এবং ওনাকে জানতে দিইনি আমি, সেই জেদটা। আর উনি সেদিন থেকে বসে গেলেন।

    শ.দ. – নেশা করা শুরু করলেন?

    সু.মা. –  নেশা তো অনেক দিন আগে থাকতেই করেছিলেন, মানে উনি একানি থেকেই নেশা করা ধরেছিলেন, মানে ওনার যে গুরু, মানে শিক্ষক, যাত্রাদলের, তিনি নেশা করতেন এবং তিনিই শিখিয়েছিলেন। তিনি নিতেন এবং পিছন করে দিতেন। আমাকে গল্প করেছেন আমার স্বামী, যে সুধাংশুবাবু আমাকে হাতেখড়ি দিয়েছেন, যাত্রাজগতে,

    শ.দ. – তোমাদের এমনি চলত কি করে?

    সু.মা. – হ্যাঁ নদীতে জাল টেনে খেত, এবং আমিও জাল টানতাম। ছোট ছোট বাগদা। আমি রাতেও উঠে চলে যেতাম। সবাই ঘুমাত। আমি রাতে... আমি তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করে নিয়ে, সবকিছু করে নিয়ে, মাও রান্নাবান্না করে নিতেন, নিয়ে একসঙ্গে করে জাল টানতে যেতাম।

    তারপর পর পর ওইভাবে চলতে চলতে কন্ট্রোলের চাল, চার টাকা দামের, এখন পুরো দু টাকা দামের চালের এসে গেছে। যাই হোক, ষোল কিলো চাল, আমার শ্বশুরের ঘরে, মানে আমার স্বামীর ঘরে, ষোল কিলো চাল, আয়লার চাল পাওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত, মমতাদি, দিয়ে রেখেছেন, আট কিলো চাল এমনি, আর বারো কিলো গম।

    শ.দ. – এটা তোমরা বিপিএলের এতে পাও?

    সু.মা. – হ্যাঁ সুপার বিপিএল থেকে। খুব সুন্দর সুযোগ করে দিয়েছিলেন মমতাদি, ধন্যবাদ তাঁর, ভালো থাকুক, এবং তিনি আরও দীর্ঘজীবী হোক, যাই হোক আমরা এইভাবে জীবিকানির্বাহ করে এইভাবে চলছি।

    শ.দ. – তো তুমি যাত্রাপালা করতে যেতে অন্যান্য জায়গায় আর মিন ধরতে? আর তাছাড়া তো সংসারের অন্য কাজও ছিল।

    সু.মা. – হ্যাঁ। তারপরে আমি একদিন বললাম, যে এইভাবে হয় না। সংসার শুধু জীবনে বেঁচে থাকার, বেঁচে থাকা ছাড়া কিছু উন্নয়নের রাখা যাবে না, কিছু রেস্ত করা যাচ্ছে না। তারপরে টিউশনি ধরলাম। তবু আমি নিজে থেকে বলিনি, সব গার্জেনরা এসে আমাকে বলল, যে আমাদের বাচ্চাগুলোকে শেখাবে, অ-আ-ক-খ, শিখিয়ে দাও না, যতটা পারো, যতদিন পারো, করো না। তো আমি বাচ্চাদের অ-আ-ক-খ থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াতাম। বাড়ি বাড়ি যেতাম। সকাল-বিকাল করে, টিউশনি করে কোনোরকমে, চালাতাম। আনাজ-টানাজগুলো তো কিনে খেতে হবে না? জলটা বাদ দিয়ে নিজের ড্রেসপত্তর, অনেককিছু। চাল তো দু টাকা দরে পেয়ে যেতাম, কিন্তু এগুলো তো দু টাকা দরে পাব না।     

    শ.দ. – সে সময় স্বামী ...  

    সু.মা. – মানে অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রচুর সন্দেহ করতেন। যে আমার অভিনয় ওটা, আমি তো সত্যিকারের তার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী হয়ে যাচ্ছি না, আমি বুঝিয়েছিলাম, আমি সত্যিকারের তার স্ত্রী হয়ে যাচ্ছি না, বা আমি সত্যিকারের তাঁর সাথে থাকছি না। বলছে না, তোমার মধ্যে এমন একটা গুণ আছে, সব ছেলেরা দেখলেই তোমায় সত্যিকারের ভালোবাসে। আমি বলি, কক্ষনো না। মানুষের ব্যবহারটাই সবচেয়ে মিষ্টি মধুর। এই ব্যবহারটা যার সঙ্গে রাখতে পারবে, সে কিন্তু চিরকালের সুধা হয়ে থাকবে। তুমি এটুখানি ভুল বুঝো না। না তোমাকে অভিনয় করতে দেব না। অভিনয় করতে গেলে তোমাকে তো জড়াতেই হবে। তাই তোমাকে করতে দেব না। আমি যতদুরই জেদ করব, ততই আমার জেদ বাড়বে। তুমি জেদ করবে, আমি আস্তে আস্তে ছেড়ে দেব অভিনয় করা। তো আমার দাদারা ডাকল।

    নিজেও যাওয়া বন্ধ করে দিল আর আমাকেও স্টপ করে দিলেন। তারপর দাদারা বই ধরল। দাদারা আসলে এখন আমাকে ডাকে। ঠিক পুজোর সময়... আমার বড়দা।

    মাঝখানে কয়েক বছর বন্ধ ছিল। আমার খুব ইচ্ছা হত করার, সবাই করত যেতাম দেখতে। খুব কান্না পেত ভিতরে। যে প্রতিভাটাকে আমি জাগিয়ে তুললাম ভিতরে, সেই প্রতিভাটাকে কীভাবে স্টপ করে দিল। আমি নিজেই ভাবতে পারছি না। কেন আমাকে এরকম করল। আমি তো সবদিক দিয়ে ইনকাম করে খাওয়াচ্ছি। উনি তো কিছুই করেননা। তাহলে একটু অভিনয় করব, তাও কেন করতে দিচ্ছেন না। গান অর্থাৎ জ্ঞান তো। মানুষকে বুঝিয়ে দেব। বুঝিয়ে বলব। যাই হোক, আমার বড়দা যখন আবার স্টার্ট করলেন, আমি সেই স্টার্টের সাথে আছি।  

    বড়দাদের সূর্যতোরণ অপেরা। তো বড়দা ওখানে পুষ্পমালা বই ধরেন। তাতে আমি রানিমা করি। আর অন্য এক জায়গায় পুষ্পমালা বই করতে গিয়েছিলাম, সেখানে পুষ্প করেছিলাম। আরেক জায়গায় করেছিলাম, সেখানে কাঞ্চন করেছিলাম। এইভাবে বইটা আমার পুরো মুখস্থ হয়ে আছে। বই করতে কুমিরমারি, আমতলি, তারপরে পুঁইজালি, ঝিঙ্গেখালি না কি যেন, অনেক দূরে দূরে গেছি। বা সাতজেলিয়াতে করেছি।

    শ.দ. – কোন সময়ে হয় এটা, বছরে?

    সু.মা. – হ্যাঁ পুজোর সময়ে হয়, তারপরে, গরমের সময়ে বৈশাখ মাসের দিকে, চৈত্র মাসের দিকে...

    শ.দ. – তা তুমি এখনও তো ইনকাম করো যাত্রা থেকে?

    সু.মা. –  হ্যাঁ।

    শ.দ. – তখন যে শুরু করেছিলে ক্লাস ফাইভে, আশি টাকা থেকে কুড়ি টাকা কেটে ষাট টাকা, তা এখন কিরকম পাও?

    সু.মা. – এখন দু হাজার, দেড় হাজার, আড়াই হাজার।

    শ.দ. – একেকটা শো থেকে?

    সু.মা. – হ্যাঁ। তিন হাজার।

    শ.দ. – আর তোমার শ্বশুরবাড়ির, আশেপাশে যে গ্রামের মানুষ, বিরাজনগরের, তারা কি এই...

    সু.মা. – কখনও আপত্তি করেনি।

    শ.দ. – না আপত্তি তো করবে না, কিন্তু ধরো তুমি একজন বিবাহিত মেয়ে, যাত্রা করতে বেরিয়ে যাচ্ছ ঘরের বাইরে, তিন চার রাত বাদে হয়তো শো করে ফিরলে, এই নিয়ে কোনও কথা তোমাকে কখনও শুনতে হয়নি?

    সু.মা. – না না। আমার পাড়া প্রতিবেশী আমাকে আরও সাহায্য করত। আরও সাহস দিত। যে করো। ওর যখন দমের কষ্ট হয়ে গেছে, মানে বলতে নেই, উনি লোহার কাজও করেছেন। মানে কল বসানোর কাজও করেছে। এবং সেই থেকে বুকে হার্ট অ্যাটাক হয়ে ওই যে দমের কষ্ট এসে গেল, সে থেকে উনি পুরো বসে গেলেন, আর কোনোকিছু করতে পারেন না।   

    শ.দ. - তারপর থেকে পরিবার কি ভাবে চলে, ছেলে মেয়ে দের নিয়ে কিছু বলো। কোলকাতাতে কীভাবে এলে। ছেলে মেয়েরা এখন কি করে।

    সু.মা. – মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়তে পড়তে নিজের রাস্তা নিজে দেখে নিয়েছে। আমার দেখার সামর্থ্য নেই। মানে বাবা গরিব বলে... দিতেই পারবে না কিছু। তাই আমি বলেছিলাম, যে বাবা গরিব তো কি হয়েছে, আমি সবার কাছ থকে সাহায্য নিয়ে, আমি তোকে বিয়ে দেব। তুই পড়াশুনা করে নে। আর দুটো ক্লাস পড়, অন্তত তিনটে ক্লাস।

    শ.দ. – কোথায় পড়ত মেয়ে?

    সু.মা. – মেয়ে ক্যানিং আইডিয়াল মিশনে পড়ত। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতাম।  খ্রিস্টানদের। আমার ছেলেটাও ওখানে খ্রিস্টান...

    ও ভালই রেজাল্ট করত।

    শ.দ. – মানে মেয়ে ক্লাস এইট অবধি পড়েছে?

    সু.মা. – হ্যাঁ হ্যাঁ।

    শ.দ. – তারপরে?

    সু.মা. – তারপর বাড়িতে ওখানে একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটা ছেলের সঙ্গে, তখন বাড়িতে নিয়ে চলে আসলাম। তা নিয়ে আসার পর আমার উপর মেয়ে খুব রাগ, যে ছেলেটাকে আমি পছন্দ করেছি তাকে বাদ তুমি আমাকে অন্য ছেলের হাতে হয়তো দিয়ে দেবে। আমি বললাম, না তোর এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। আমি অল্প বয়সে বিয়ে করেছি বলে তকেও অল্প বয়সে বিয়ে দিতে পারব না। কারণ আঠারো বছর না হলে মেয়েদের বিয়ে হয় না। যার জন্য আমার শরীরটা দেখেছিস কি রকম অবস্থা হয়ে গেল? ঠিক ওইরকম হয়ে যাবে, তোর শরীর ভেঙে যাবে। বুঝিস না। কিন্তু মেয়ে আমার... কাকিমার বাড়িতে থাকত। কিন্তু মায়ের মন তো, বোঝে না। তবু ডাকতাম, আয় খাবি আয়। বোঝাতাম, আমি এখানে গোসাবার স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি পড়। আমি টিউশনি করে যা পয়সা পাব, তোদের খাওয়াব, পড়াব, খরচা দেব। লোকের কাছে সাহায্য চেয়ে তোদের পড়াব, তোরা পড়।

    শ.দ. – যে ছেলেটির সাথে ভাব ছিল, তার সাথেই...

    সু.মা. – না না। অন্য ছেলে।

    শ.দ. – আচ্ছা। এখন কি সেই ছেলেটির সাথেই ও আছে?

    সু.মা. – হ্যাঁ।

    শ.দ. – বিয়ে করেছে তাকে? কোথায় থাকে? 

    সু.মা. – হ্যাঁ। সেটা উত্তরপ্রদেশ।

    শ.দ. – কি বাঙালি ছেলে বিয়ে করেছে?

    সু.মা. – হ্যাঁ।

    শ.দ. – কেমন আছে মেয়ে?

    সু.মা. – ভালো আছে। আসা যাওয়া করে। মানে ছেলেটা খুব ভালো ছেলে।

    শ.দ. – ছেলে কি করে?

    সু.মা. – ঘাস কাটে, মেশিনে। আর মেয়ে কাপড়ে জরি বসানোর কাজ করে।

    শ.দ. – উত্তরপ্রদেশে কোথায় থাকে?

    সু.মা. – আমি ঠিক জানি না। আমি কখনও যাইনি।

    শ.দ. – তো মেয়ে আসে?

    সু.মা. – হ্যাঁ আসে। প্রতি বছর আসে। এবছরও আসতে বলেছিলাম পুজোর সময়, তো জানি না কি রাগারাগি হয়েছে। ও আমাকে ফোনটোন করে না। আমার নাম্বারটা ডিলিট হয়ে গেছে, করতেও পারি না। ছোট দুটো বাচ্চা আছে। দুজনেই ছোট।

    শ.দ. – আর তোমার ছেলের কত বয়স?

    সু.মা. – ছেলের সতের বছর বয়স। সেও মিশন স্কুলে পড়েছিল ক্লাস ফোর অবধি, ক্লাস ফোরে সুন্দরভাবে পাশ করল, ওখানে আর এ করল না, তখন বললাম, তাহলে গ্রামের স্কুলে ঢুকিয়ে দিই? বয়েস স্কুল? বলল না আমি দেশের স্কুলে পড়ব না, আমি গোসাবার স্কুলে পড়বো। তো গোসাবার স্কুলে ভর্তি করে দিলাম।

    ওদের আমি বুদ্ধি করে অরফ্যান করে নিয়েছিলাম। মানে দরখাস্ত লিখে, সবার সাক্ষর নিয়ে, আমি নিজে হাতে স্যারের কাছে দিয়ে এসেছিলাম। এবং খুব রিকোয়েস্ট করেছিলাম যে দুটো ছেলেমেয়েকে আপনি অরফ্যান করে নিন কারণ আমি নদীতে জাল টেনে কীভাবে এদের পড়াশুনা শেখাব? আপনারা কি চান না এঁরা পড়াশুনা শিখুক?

    গোসাবার স্কুলে এইট অবধি পড়ে তারপরে বন্ধ করে দিল। আমাকে বলল যে, আমাকে টিউশনি দাও। বললাম দুশো আড়াইশো টাকা করে টিউশনি, কি করে দেব। নিজে তো করছিস, কর না। আমি বাংলাটা করে দেব, ইংলিশটা হয়তো পারব না। অনেকদিন পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছি, চালু নেই। তাহলে তুই... খুব সুন্দর পড়াশুনা করত। সুমন মাঝি আমার ছেলের নাম... মেয়ের নাম কঙ্কন মাঝি।

    শ.দ. –সুমন কোথায় কাজ করে এখন?

    সু.মা. – ব্যাঙ্গালোরে যাবে বলছে। আমি বললাম যেতে হবে না। বলল, তাহলে আমি তামিলনাড়ু যাব। কিছুদিন আন্দামানে ছিল... 

    শ.দ. – আন্দামানে ছিল?

    সু.মা. – হ্যাঁ। ওখানে সব্জির কাজ করত। বাগানে। সেখানে মাইনাপত্তর পায়নি, অল্প কিছু পেয়েছে। বাড়িতে এসে কালকে আমার সাথে এক ঘণ্টা ধরে কথা বলল। মা তুমি কখন আসছ। বললাম পঞ্চমীর দিন আসছি। তুমি রোলের খাতাটা কোথায় আছে দেখে বার করে দিয়ে যাবে। আমি সপ্তমীর দিন বাড়িতে ঢুকব। আমার রিহার্সাল আছে সাতজেলিয়াতে। তা বলছে কোন বই? আমি বললাম পুষ্পমালা বই। তা বলছে ওটা তো তুমি জানো, মুখস্থ, তাও তোমার খাতা লাগবে? বললাম তবু, অনেকদিন দেখা নেই, একটু দেখতে হবে, কোথায় ভুল হয় না হয়, তাঁদের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে হবে। আমার বাপের বাড়ির ওরা, দাদারা আমরা সবাই একসাথে পুষ্পমালা বই করি।

     

    এই কথোপকথনের কোন অংশ বাদ দিয়ে সংক্ষেপিত করবার সাহস হয়নি। কেননা একজন মানুষের নিজস্ব আখ্যানের মধ্যে তাঁর লড়াইকে বোঝা সব থেকে সহজ। এবং আলাপের উদ্যগে ‘সুন্দরবনের মেয়েরা’ যে ব্লগে নিয়মিত চর্চা সেখানে আমরা খুঁজে পাচ্ছি প্রকৃতি সমাজ ও ক্ষমতার সাথে বহুমুখী লড়াইকে। তাই সুন্দরবনের মেয়েদের জীবনচর্চাকে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করবে সুলতাদি, আর তাঁর জীবনযাপন, আর অন্যভাবে বেঁচে থাকার আলাদা লড়াইগুলো। আলাপপর্বের এই লেখাটি তাই সুলতাদি মূলত লিখছেন। আমদের জানা বোঝা, আর তাকে আমাদের চোখ দিয়ে বর্ণনা করবার দুঃসাহস না দেখানোই শ্রেয় বলে মনে করছি। 

     
     



    Tags
     



    1 Comment
    • এ এক অন্য জীবন অধ্যয়ন… পড়তে পড়তে মৌখিক ইতিহাসের চলন মনে করায় সুলত দি সামনে বসে কথা বলছেন। পড়তে পড়তে কিছু মুদ্রন প্রমাদ চোখে আসে, তা সংশোধন দরকার ছিল। কথা বলার চলন অবিকৃত রাখার প্রয়াস মৌখিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে অনেক সময় হয় না, এখানে সে প্রয়াস করা হয়নি দেখে ভালো লাগল।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics