মেয়েদের চৌষট্টি কল: দূরবীন, কিন্তু দেখিবে কে?
4 440
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'চারুলতা' (১৯৬৪) ছবিতে দূরবীন চোখে চারুলতা “তোমরা লোহার তারে পৃথিবীময় লিপি চালাইতে পার, আমরা কি নলটি চালাইতে পারি না? তোমাদের একটি ভ্রম আছে, তোমরা মনে কর যে, ইংরেজরা যাহা জানে তাহাই সত্য, যাহা ইংরেজ জানে না, তাহা অসত্য, তাহা মনুষ্যজ্ঞানের অতীত, তাহা অসাধ্য...”
(রজনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)রজনী প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৮১-৮২ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শনে। ততদিনে লোহার তারে পৃথিবীময় লিপি অর্থাৎ টেলিগ্রাফ ভারতে এসে গিয়েছে। ‘রজনী’-র সন্ন্যাসী তাকে উপেক্ষা না করলেও সওয়াল করেছেন প্রাচীন ভারতের চর্চা-বিচ্ছিন্ন জ্ঞানভান্ডারের পক্ষে। যে জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি রজনীর অন্ধত্ব আরোগ্য করলেন, আধুনিক পরিভাষায় তার নাম হয়ত Traditional Knowledge or indigenous knowledge or local knowledge।
অথচ এর প্রায় এক দশক পর প্রকাশিত ‘দেবী চৌধুরানী’-তে দেখছি দেবী অবলীলায় হাতে তুলে নিচ্ছে দূরবীন।
“গালিচার উপর একটা ছোট দূরবীন পড়িয়াছিল। দূরবীন তখন ভারতবর্ষে নূতন আমদানি হইতেছিল। দূরবীন লইয়া সুন্দরী ঐ ব্যক্তির হাতে দিল, কিছু বলিল না। সে দূরবীন চক্ষে দিয়া নদীর সকল দিক নিরীক্ষণ করিল...।”
শুধু দেবী বা প্রফুল্ল নিজেই দেখেনি, সে দিবার হাতেও এই যন্ত্র তুলে দিয়েছিল।
“ঠিক যে দিকে দেখিতে হইবে, দেখাইয়া দিল। দিবা দেখিল।” শুধু ব্যবহারই নয়, প্রফুল্লর কথার মধ্যেও ঢুকে পড়ছিল প্রযুক্তির লব্জ। সে দিবাকে বলেছিল, “যাহা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছিলে না, তা যেমন দূরবীক্ষণের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিলে, তেমন ঈশ্বরকে মানস প্রত্যক্ষ করিতে দূরবীন চাই।”
দিবা যে দূরবীনের সঙ্গে সম্যক পরিচিত, তা বোঝা যায়, কারণ সে আদৌ প্রশ্ন করে না দূরবীনটা কী জিনিস, বরং সে আলোচনা আদিভৌতিক দিকে নিয়ে যায় এই বলে, “মনের আবার দূরবীন কি?” শুধু দূরবীনই নয়, দেবী ও তার সখীরা অন্তত আর একটি যন্ত্রের ব্যবহার জানতেন, তা হল বন্দুক। প্রয়োজনে যা তাঁরা ধরতেন। যদিও “দেবীর স্থিরবুদ্ধিই শাণিত মহাস্ত্র, তার আর অন্য অস্ত্রের প্রয়োজন নাই।”
‘স্ত্রীর পত্র’-র মৃণাল অবশ্য বলেছিল মেয়েমানুষের জন্য বুদ্ধি একটা বালাই। পশমের কাজের উলটো পিঠের অন্দরে সূর্যের আলো ঢুকতে পেত না, সূর্যের আলোর চেয়েও অস্পৃশ্য ছিল বিজ্ঞান প্রযুক্তির পাঠ। তাই বোধহয় ‘নষ্টনীড়’-এর চারু, ধনী গৃহে যার কোন কাজ ছিল না, তার হাতে দূরবীন তুলে দেবার কথা ভাবেননি রবীন্দ্রনাথ। সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হল সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ অব্দি। আমরা সেখানে দেখি চারুলতা বেশী মাধবী জানলার খড়খড়ি তুলে বাইরের পৃথিবী দেখছেন, তাঁর চোখে দূরবীন। এই যন্ত্রটির সঙ্গে যে তাঁর নবীন পরিচয় তা বোঝা যায় মাধবীর চোখে মুখে খেলে যাওয়া উত্তেজনা মিশ্রিত আনন্দের হিল্লোল দেখে। আমাদের আরো মনে পড়বে এই মাধবীই সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবির নায়িকা হবেন পরবর্তীকালে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বিখ্যাত ‘অবতরণিকা’ গল্প নিয়ে যে ছবি, যেখানে বাঙালি মেয়ের চাকরিজীবনের শুরুর নিখুঁত ডকুমেন্টেশন রয়েছে। আর সে চাকরিটাও মেয়েদের জন্য একেবারে ছকে বাঁধা ইস্কুলের দিদিমণি নয়। যদিও দিদিমণিগিরি করতে হয়, তবে তা উল বোনার মেশিন বেচতে গিয়ে। এখানে কোথাও একটা নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটে গেল। স্বয়ং কেশবচন্দ্র সেন যেখানে বলেছিলেন “মেয়েরা জ্যামিতি শিখিয়া কি করিবে?” সেখানে একটি সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহবধূ, যে তার স্বামীর আগে খেয়ে বেরিয়ে গেলে শাশুড়ী বিলাপ করেন, সে কিনা তার উপার্জন শুরুই করছে একটি বিলিতি যন্ত্রের কলা কৌশল বুঝিয়ে। সেখানে একটি ধনী গৃহে যখন বাড়ির বউটি কিছুতেই যন্ত্রটির কাজের পদ্ধতি বুঝতে পারছে না, তখন মৃদু অনুযোগের সুরে আরতি বলে “আপনার তো ভারি মোটাবুদ্ধি।” সে কথায় রুষ্ট হন বউটির শাশুড়ী, তিনি আরতিকে বুঝিয়ে দেন তাঁদের মতো ঘরে মেয়েদের বুদ্ধি একটু কম হলেও চলে। অর্থাৎ মেয়েদের বুদ্ধি, বিশেষত কলকব্জা সংক্রান্ত বুদ্ধি জুড়ে যাচ্ছে অর্থকৌলীন্যের ওপর। এখানে আরেকটি কৌতুকজনক ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। ‘চারুলতা’-এ দূরবীন হয়ে উঠেছিল মেয়েদের ঘর আর বাইরের প্রায় অনতিক্রম্য দূরত্বের প্রতীক,(এ সেই যুগের ভাষ্য যখন ‘বঙ্গমহিলা’ পত্রিকার ১২৮২ শ্রাবণ সংখ্যায় জনৈক মায়াসুন্দরী আক্ষেপ করেছিলেন “স্ত্রীলোকের কিছুই দেখিবার হুকুম নাই। গঙ্গার উপর পুল নির্মাণ হইল, লোকে তাহার কত প্রশংসা করিল, কিন্তু আমাদের শোনাই সার হইল, একদিনও চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিতে পারিলাম না”) আর ‘মহানগর’-এ আরতির হাতে তার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সহকর্মীণি তুলে দিল যন্ত্রজাত প্রসাধনী লিপস্টিক, যাকে আমরা বলতে পারি বাঙ্গালিনীর যৌন চেতনার প্রথম আলো!
এই দৃশ্যটি আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে, কারণ আমরা অবাক হয়ে দেখি, নারী থেকে নারীর হাতে এল প্রকৌশল। এর আগে তো এর বিপরীতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। প্রতিদিন উপাসনার সময় সহজ সরল করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলি মেয়েদের বুঝিয়ে দিতেন দেবেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারীর প্রথম জাহাজ দেখে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উদ্ভাবন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠা, সেও মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের দৌলতে। ‘যোগাযোগ’-এ কুমুর ফটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি বিপ্রদাসের হাতে, ‘দুই বোন’-এর শশাঙ্ক উর্মির জন্য এনে দিয়েছিল যান্ত্রিক ছবি আঁকার সরঞ্জাম।
তবে পুরুষ যে সবসময় যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানের রহস্যলোকের দরজা নারীর সামনে খুলে দিয়েছে তা নয়, কখনো কখনো যন্ত্র হয়ে উঠেছে রোমান্সের দূতী। যেমনটি দেখা যায় শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’-তে -
“দেখিবার কৌশলটা নরেন প্রাণপণে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছে, প্রত্যেক কলকব্জা নানাভাগে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখাটা সহজ ক্রিয়া তুলিবার বিধিমত প্র্য়াস পাইতেছে। কিন্তু দেখিবে কে? যে বুঝাইতেছে, তাহার কণ্ঠস্বরে আর একজনের বুকের ভিতরটা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে, প্রবল নিশ্বাসে তাহার এলোচুল উড়িয়া সর্বাঙ্গ কণ্টকিত করিতেছে, হাতে হাত ঠেকিয়া দেহ অবশ করিয়া আনিতেছে – তাহার কি আসে যায় জীবাণুর স্বচ্ছদেহের অভ্যন্তরে কি আছে, না আছে দেখিয়া? মিনিট দশেক ধস্তাধস্তি করিয়া নরেন অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া সোজা উঠিয়া বসিল; কহিল, যান এ আপনার কাজ নয়, এমন মোটাবুদ্ধি আমি জন্মে দেখিনি।”
যন্ত্রের ব্যবহারকারী থেকে উদ্ভাবক – এই দীর্ঘ রাস্তা নারীর কাছে যে সুগম হবে না তার ইঙ্গিত নারীমনের ডুবুরী শরৎচন্দ্র মোক্ষম রেখে গেলেন এই দুই চাবিবাক্যে –
১। “দেখিবে কে?”
২। “এ আপনার কাজ নয়”
প্রথমটি নারীর দুর্বলতা, দ্বিতীয়টি সমাজের।
তথ্যসূত্র –
প্রযুক্তি ও নারী–বিবর্তনের প্রতি-ইতিহাস, তৃষ্ণা বসাক, গাঙচিল
বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র রচনাবলী, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পমালা ও অন্যান্য।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Comments (4)
-
-
পর্যায়ক্রমে বাঙ্গলা সাহিত্যে, নারী ও প্রযুক্তি সম্পর্ক যুক্ত বিবর্তনকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন তৃষ্ণা ! পড়ে বেশ ভাল লাগল !
-
খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন বাস্তব ছবিটা। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ বেশ ভালো লেগেছে।
-
অসম্ভব ভালো লেখা ।যা শুধু মুগ্ধ করেনা ।ভাবতে শেখায় । ভাবনার স্তরগুলোকে শানিত করে তীক্ষ্ণ করে । তৃষ্ণা বসাকের লেখার যে গতি যে যুক্তিজাল তা তার বৌদ্ধিক গদ্যে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত । প্রযুক্তি ও নারী এই বিষয় নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন তিনি ।রচনা করেছেন একটি আকর গ্রন্থও । মেয়েদের চৌষট্টি কল ঃ দূরবীন কিন্তু দেখিবে কে । নারী এবং প্রযুক্তির পাঠ যেন দুই দিগন্ত ।রবীন্দ্র বঙ্কিম শরৎ এবং নরেন্দ্রনাথ মিত্রএর রচনাসমুহের নিবিড়পাঠ এবং পারিপার্শ্বিক পর্যবেক্ষন তিনি তুলে এনেছেন এই গদ্য । তৃষ্ণা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে ।
Leave a Reply
-
অনেক ধন্যবাদ বিপ্লব, যুগান্তর ও দেবাশিস ।
ভালো থাকবেন ।