• তিন দশক আগে কোথায় ছিল #MeToo?


    4    175

    November 8, 2018

     

     

    “#MeToo আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণ নয়; এটা একটা সক্রিয় আন্দোলনের অংশ যা রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয়ে গেছিল কয়েক দশক আগে থেকেই”...

    (কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হেনস্থা প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক রাজশ্রী দাশগুপ্ত বলছেন তাঁর কর্মজীবনের প্রথমদিকের অভিজ্ঞতা)

    আমি যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে। সময়টা ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি। মিডিয়া জগতে আমার যে সহকর্মী/সহ-সাংবাদিকরা যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে এগিয়ে আসছেন এখন, তাদের বেশিরভাগেরই হয়ত জন্মই হয়নি তখনও। যদিও ‘এসব ব্যাপার’-এর জন্য তখন আমাদের কাছে সেভাবে কোনও বিশেষ নাম ছিলনা... তবু আমরাও আজকের এই মেয়েদের মত এতটাই বিরক্ত এবং আতঙ্কিত ছিলাম নির্যাতনকারীর লালসার দৃষ্টি থেকে পালাতে পালাতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #MeToo যত ছড়িয়ে পড়ছে, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কীভাবে এরকম হেনস্থা প্রায় একটা স্বাভাবিক রুটিনে পরিণত হয়েছিল - মেয়েদের প্রতি অন্য সবরকম নির্যাতনের মতই,  কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই সমস্যার প্রায় কোনওরকম স্বীকৃতিই ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ইভটিজিং’ বা ‘মজার-ছলে-করা’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হত, তুচ্ছ হয়ে যেত আমার মত অনেক মেয়ের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।

    আমি যখন কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ সাব-এডিটর ছিলাম, সেই সময়ে আমাদের নিউজ এডিটর আমাকে যৌন নির্যাতন করেন। তিনি মদ্যপ ছিলেন। শুরুতে আমি লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম, আর শ্রদ্ধাও করতাম। যতই হোক, তাঁর কাগজে আমি আমার প্রথম চাকরিটা পেয়েছিলাম, অর্থনীতির ছাত্রী না হওয়া সত্বেও। এমনকী আমার প্রথাগত শিক্ষাতেও একটা বড় ফাঁক ছিল, কারণ বাম রাজনীতি করার সুবাদে প্রথমে কলেজ ছাড়ি, তারপর ’৭০-এর দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় জেলে যাই এবং ছাড়া পাই ’৭৭-এ জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর - তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিপুল ভোটে হেরে যাওয়ার পর সারা দেশে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী জোরদার হয়ে উঠেছিল।

    আমার নতুন বস-কে খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, কারণ শুনেছিলাম, এমার্জেন্সির সময় মিডিয়ার সিংহভাগ যখন, লালকৃষ্ণ আডবাণীর ভাষায়, “মাথা নোয়াতে বললে পায়ে পড়ে যাচ্ছে”, তখন তিনি এবং আরো কয়েকজন সাংবাদিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাষ্ট্রের ফতোয়ার বিরুদ্ধে অটল ছিলেন। আরেকটা ভাল ব্যাপার ছিল, উনি আমাকে ৮ই মার্চ শহরে নারীদিবস উদযাপন নিয়ে আমার প্রথম ফিচার আর্টিকলটা লিখতে দিয়েছিলেন। তদুপরি, সেটা একটা বাণিজ্য ও অর্থনীতির কাগজের জন্য, যেখানে ওইসময়ে সাধারণ কাগজগুলোও মেয়েদের নিয়ে খুব কম খবর করত। বলতে গেলে, আমি এবং আমার কয়েকজন মহিলা সহকর্মীই বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে মেয়েদের প্রথম ব্যাচ।

    হেনস্থাটা শুরু হয়েছিল অপ্রত্যাশিতভাবেই। আমি প্রথমদিকে ওনার ভণিতাগুলো নিয়ে বিশেষ ভাবিনি, এড়িয়েই গেছিলাম। যৌন হেনস্থা কী, তা আমার অজানা ছিল না – রাস্তাঘাটে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এরকম ঘটনার কথা কে না জানে! তাছাড়া, সেদিনের কলকাতায় রাস্তার লোকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত, যদি কোনও মেয়ে চেঁচায় বা প্রতিবাদ করে। কিন্তু কাজের জায়গার মত আপাত নিরাপদ আশ্রয়ে, যেখানে অল্পবয়সীরা হেনস্থার শিকার হওয়ার কল্পনাই করতে পারেনা, সেখানে? এবং সেটাও এমন একটা অফিসে যেখানে আশেপাশে সাংবাদিকদের ভিড় – যে উজ্জ্বল, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবিরা বদলে দেবে পৃথিবী, হাতে ধরে তৈরি করবে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।

    সাংবাদিকতায় এসেছিলাম চাকরি নিতেই, সত্যি কথা, কিন্তু তার পাশাপাশি, সেসময় সংবাদপত্রে কাজ করা নিয়ে একটা অন্যরকম আদর্শ ছিল, কিছুটা সেই টানেও মিডিয়ায় এসেছিলাম। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্য কোনদিনই আমার পছন্দের বিষয় ছিল না, কিন্তু নতুন কিছু শেখা আর অনন্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সুযোগ ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম না। তাছাড়াও আমার বিয়ে এবং অল্পবয়সে মা হওয়ার পাশাপাশি পরিশ্রম ও কাজের প্রতি আগ্রহ – এই সবই ছিল। তবু, পরিবর্তে আমি পেলাম কঠিন শিক্ষা, হাতেনাতে শিখলাম কাকে বলে যৌনতার রাজনীতি, আর কীভাবে তথাকথিত ভদ্র, মুক্তমনের পুরুষরাও তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে এই কাজে।

    শুরুটা হয়েছিল ছোট ছোট ফরমায়েশ দিয়ে : আমার ডেস্কে বসে কাজ কর; ক্রমশ সেটা হয়ে গেল, এসো আমার এখানে এসে বস। আমার অস্বস্তি হত, বুঝতে পারতাম না কী করা উচিত। ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যখন তিনি নানারকম পীড়াপিড়ি করতে শুরু করলেন : তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসো না কেন, অফিসের সবার সাথে হেসে কথা বল, কিন্তু আমাকে পাত্তা দাওনা কেন? তারপর সেটা জোর করার পর্যায়ে চলে গেল : আমার দিকে তাকাও, এবার হাস, তোমার কথা বল আমাকে। অফিসের ইণ্টারকমে ফোন করে ওনার নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলে যেতেন, তারপর ওনার সাথে কফি খেতে বেরোতে বলতেন। ‘কাউকে বল না যেন’, সঙ্গে সঙ্গে যোগ করতেন। একদিন নাইট শিফটের সময় আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম, উনি দুহাত ছড়িয়ে সরু করিডরটা আটকে দাঁড়িয়ে আছেন, যতক্ষণ না হাসলাম এবং ওনার সাথে কথা বললাম ততক্ষণ পথ ছাড়লেন না।

    অতিরিক্ত মদ্যপানের একটা সমস্যা ছিল ওনার। সকালের শিফটে ওনার কথাগুলো কিছুটা এলিয়ে গেলে রাতের শিফটের মধ্যে উনি টলতে শুরু করতেন এবং কথাবার্তা এত জড়িয়ে যেত যে প্রায় কিছুই বোঝা মুশকিল হত। একদিন উনি সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে পড়লেন, দামী যন্ত্রপাতি রাখার ঠান্ডা ঘরে বসে জামাকাপড় খুলে ফেলেও দরদর করে ঘামতে লাগলেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই ওনার আচরণে বিরক্ত হত, কর্তৃপক্ষ কী করে অফিসের মধ্যে এরকম মদ্যপ অবস্থা মেনে নিচ্ছে সেটা ভেবেও অবাক হতাম। সহকর্মীদের ঠান্ডা নীরবতাও আমাকে হতাশ করত, বিশেষ করে কলকাতার মত জায়গায়, যেখানে রাস্তার অচেনা লোকও মহিলাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।

    #MeToo আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার এবং আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে যখন যৌন হেনস্থা নিয়ে প্রায় সকলেরই একটা মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা রয়েছে, তবু মাত্র কয়েকদিন আগে আমার একজন প্রবীণ প্রাক্তন সহকর্মী, যিনি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ কী কী ঘটেছে তার সাক্ষী ছিলেন, আমাকে বললেন, “ওটা ঠিক হেনস্থা ছিল না; আসলে ওনার মদের সমস্যাটাই কারণ।” নিজের দেখাটাকে এরকমভাবে অস্বীকার করার প্রবণতার দুটোই কারণ হতে পারে : হয় সেটা তাদের নিষ্ক্রিয়তা ঢাকতে, যখন হয়ত তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে পারতেন; অথবা, আরেকটু দয়াপরবশ হয়ে বলা যায়, এর কারণ তাঁদের দীর্ঘ অজ্ঞানতা – মেয়েদেরকে কাজের জায়গায় কীরকম পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়, সেই ব্যাপারে কোনও ধারণাই তাঁদের নেই। আমার একজন সহকর্মী কিছুটা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন - জগন্নাথ বা জগ্গি নামে পরিচিত সেই সিনিয়র আমাকে সবার আড়ালে বলতেন ডেস্কে তাঁর পাশে বসতে – ওনার বলার সেই ভঙ্গিটা এখনও মনে পড়ে, ওঁকে ধন্যবাদ দিই মনে মনে।

    সেসময়ে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অফিস আর আনন্দবাজার গোষ্ঠীর দৈনিক কাগজের অফিস ছিল একসাথেই একটা বড় হল ঘরে; সেখানে কোনও দেওয়ালের ভাগ বা আলাদা কুঠুরি ছিল না। সরল বিশ্বাসে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, সমস্ত সহকর্মীদের মিলিত প্রতিরোধ এলে এরকম আপত্তিকর আচরণ বন্ধ হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে বুঝলাম, উনি আমাদের কাগজের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছেন, এমনকী প্রতিনিয়ত তাঁর এইধরনের গোলমাল বাধানোয় কর্তৃপক্ষ অস্বস্তিতে থাকলেও, সামান্য একজন সাব-এডিটর এর জন্য তাঁরা জলঘোলা করতে চান না।

    কিন্তু আমি চুপ করে থাকার মেয়ে ছিলাম না। প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একজন সিনিয়র এডিটর যিনি আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন, তাঁকে ঘটনাটা জানাই। তিনি শুনে বললেন, অফিসে কী ঘটছে সেটা উনি ভালোই জানেন। পাত্তা দিওনা, ওকে এড়িয়ে চল, তিনি বললেন আমায়। এড়িয়ে যাব? আমি তো চাই এই নিউজ এডিটর চিরতরে আমার সামনে থেকে চলে যাক! আমি হতাশ; আমি আরেকটু সমর্থন চেয়েছিলাম, যদিও নিশ্চিতভাবে জানতাম না সেটা ঠিক কী।

    এর পরে আমি ইউনিয়নের কাছে নিউজ এডিটর-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালাম। কাজের কাজ হোক বা না হোক, ইউনিয়ন সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিল। জিজ্ঞেস করলেন, উনি আমায় চুমু খেয়েছেন বা জড়িয়ে ধরেছেন কি না। না; আমি বললাম। তারা ধন্দে পড়ে গেলেন, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কিন্তু আমাকে তারা আশ্বস্ত করলেন যে তারা বিষয়টায় নজর রাখবেন এবং ‘উপযুক্ত পদক্ষেপ’ নেবেন। আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কারণ, যা বুঝলাম এরকম ঘটনার অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই, শুধুমাত্র ‘শ্রমিক সমস্যা’-র সঙ্গেই পরিচিত তাঁরা। আমি আন্দাজ করেছিলাম, তাঁদের ধরনটা হবে কোনোভাবে একটা কর্তৃপক্ষ বিরোধিতা, যে জিনিসটা করতে অভ্যস্ত তাঁরা।

    আরো হতাশ হয়ে দেখলাম যে নিউজ এডিটর-এর প্রতি আমার কয়েকজন সহকর্মীর মধ্যে একটা আঞ্চলিক রোষের ভাব, কারণ ঘটনাচক্রে উনি অবাঙালি এবং একটি বাঙালি মেয়েকে নির্যাতন করেছেন। কিন্তু আমার দিক থেকে সেটা আদৌ কোনও কারণই ছিল না।

    মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা নিয়ে দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেছিল ’৮০-র দশকে মেয়েদের আন্দোলনগুলোর সময়ে। থানার ভেতরে একটি নাবালিকা আদিবাসী মেয়ের ধর্ষণ নিয়ে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় বইছিল, যৌন নির্যাতনের সমস্যাটা প্রকৃত অর্থেই প্রকাশ্যে এসে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইমেল বা ফোন কিছুই ছিল না, কিন্তু নিমেষের মধ্যে হাজার হাজার মহিলা রাস্তায় নেমে পড়েন, পুরোনো খবরের কাগজের ওপর হাতে লেখা স্লোগানের পোস্টার নিয়ে।

    যৌন নির্যাতনকে হিংসা হিসেবে দেখতে ও বুঝতে একটা লম্বা সময় লেগে গেছে। ১৯৮৮ সালে ‘যৌন হেনস্থা’ শব্দটা ভারতে সাধারণের সমক্ষে আসে প্রথমবার, যখন আইএএস অফিসার রূপন বাজাজ ‘পঞ্জাবের শের’ পুলিশ অফিসার কেপিএস গিল এর বিরুদ্ধে মামলা করেন – তাঁর অভিযোগ ছিল, গিল একটি পার্টিতে রূপনের পিছনে চিমটি কেটেছেন। কাজের জায়গায় মেয়েদের নিরাপত্তা, বিশেষ করে যৌন হেনস্থা ও হিংসার বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে প্রচার শুরু হতে এরপরেও আরও কয়েকটা বছর লেগেছে। ১৯৯২ সালে, যখন গ্রামীণ সমাজকর্মী ভানওয়ারি দেবী শিশুবিবাহের প্রতিরোধ করতে গিয়ে উঁচুজাতের পুরুষদের গণধর্ষণের শিকার হন, তখন মহিলা সংগঠনগুলি একজোট হয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন, কাজের জায়গায় মেয়েদের উপর যৌন হেনস্থা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথাগতভাবে আইন পাশ করানোর দাবি নিয়ে।

    বাকিটা ইতিহাস। ১৯৯৭-এ আদালত মেনে নেয় যে যৌন হেনস্থা নারী পুরুষ সমানাধিকারের অন্তরায়, এই হেনস্থা কীরকম হতে পারে সেই বিষয়ে এবং নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেই সংক্রান্ত নির্দেশনামা দেওয়া হয়, এবং এর জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এরপরেই আসে দ্য সেক্সুয়াল হ্যারাসমেণ্ট অফ উইমেন এট দ্য ওয়ার্কপ্লেস এক্ট (প্রতিরোধ, নিবারণ এবং প্রতিবিধান), ২০১৩। যদিও মহিলারা লক্ষ্য করেন, বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জনপরিষেবামূলক সংগঠনগুলি আইনের নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়, কিন্তু বেসরকারি সংগঠন – এমনকি প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউজগুলো – এই আইনের সাপেক্ষে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে টালবাহানা করতে থাকে এবং দায়িত্ব এড়াতে চায়। #MeToo আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণ নয়, এটা একটা সক্রিয় আন্দোলনের অংশ যা রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয়ে গেছিল কয়েক দশক আগে থেকেই।

    ১৯৮০-র গোড়ার দিকে আমি যোগ দিলাম ‘সচেতনা’-য় – মেয়েদের অধিকার নিয়ে কাজ করে তারা; কলকাতা শহরে এইধরনের প্রথম কয়েকটা সংস্থার মধ্যে একটা। সদ্য তৈরি হওয়া একটা সংগঠন হওয়া সত্বেও সেখানে আমার সহকর্মীদের থেকে উৎসাহী সমর্থন পেলাম। সচেতনার সদস্যরা তৎক্ষণাৎ এবিপি গ্রুপের মালিক অভীক সরকারকে প্রতিবাদী চিঠি দিল। আমাদেরই একজন সহকর্মী, এলা দত্ত, নিজে হাতে চিঠিটা অভীকবাবুকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। এলাদি’র সাহস আর সুবিচারের বোধ এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে আমার মনে। পেশাগতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হত এলাদি’কে : উনি শুধু নিউজ এডিটরের বন্ধু ছিলেন না, পাশাপাশি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর আর্ট ক্রিটিক হিসেবে নিয়মিত লিখতেন। কিন্তু তিনি চিঠি নিয়ে সোজা এডিটরের কাছে পৌঁছে গেলেন।

    যতদূর মনে আছে, এডিটর মোটামুটি এই কথাগুলো বলেছিলেন : তিনি এই “সমস্যা”টার কথা জানতেন, কিন্তু আমি ব্যাপারটা “ভুল বুঝেছি”। সমস্যাটা যৌনতা সংক্রান্ত নয়, মদ্যপানজনিত। অভীকবাবুর অন্তত এটুকু ভদ্রতা ছিল যে তিনি সমস্যাটা অস্বীকার করেননি, কিন্তু এডিটর বা মালিকদের, অন্তত কয়েকজনের, মেয়েদের জন্য কাজের জায়গাটা নিরাপদ রাখার দায়িত্ব নিতে লেগে গেল আরও ৩৫ টা বছর - #MeToo আন্দোলনের প্রবল ধাক্কার পরে সেটা সম্ভব হল।

    হেনস্থাটা কিন্তু নিউজ এডিটর পর্যন্তই সীমিত ছিল না। তাঁর মদ্যপানের সঙ্গী, ডেস্কের একজন প্রবীণ সহকর্মী, খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন যে তাঁকে সানডে ম্যাগাজিনের এডিটর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নাইট শিফট থাকলে নিয়ম ছিল যে কর্মচারীদের অফিসের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। এরকম এক রাত্রে সেই ভদ্রলোক তাঁর ‘হতাশা’ দূর করতে গাড়ির পিছনের সিটে আমাকে হেনস্থা করতে চেষ্টা করেন। সামনের সিটে বসা অন্য এক সহকর্মীর কাছে সাহায্য চেয়েও লাভ হয় নি। বাধা দেওয়া দূরের কথা, সে ফিরে পর্যন্ত তাকায় নি। আমারই ভুল হয়ত - ড্রাইভারের কাছে সাহায্য না চেয়ে সহকর্মীর উপরে বেশি ভরসা করা।

    কয়েকদিন পরে সেই মদ্যপানের সঙ্গী ভদ্রলোক একটা দায়সারা ক্ষমা চেয়ে নেন, আর সামনে বসা সহকর্মীটি একটা লম্বা চিঠিতে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তাঁর নিষ্ক্রিয় থাকার কৈফিয়ত লেখেন। সে বলে এই ভদ্রলোক তার বাড়িতে তার স্ত্রীর সাথেও একইরকম অভব্য আচরণ করেছেন, কিন্তু সে কোনও প্রতিবাদ করেনি। মনে হয় সে অপেক্ষা করছিল আমি যদি ওনাকে শায়েস্তা করি, যাতে ওর গায়ের ঝালটাও মেটে! এঁদের দুজনকেই আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে অন্য জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম ভদ্রলোক বিজনেস ওয়ার্ল্ড-এর এডিটর নিযুক্ত হন এবং সামনের সিটের সহকর্মী অন্য প্রকাশনায় চলে যায় আরও উঁচু পদ নিয়ে। আজও মাঝে মাঝে ভাবি ওই দুজন সহকর্মীর মধ্যে কে বেশী নির্লজ্জ ছিল।

    পরিস্থিতির চূড়ান্ত মুহুর্ত এল এক রাতে। সেসময় বড় হলটা জুড়ে সাংবাদিকদের ভিড়, সবাই আনাগোনা করছে, নাইট শিফটের তোড়জোড় চলছে। আমার দ্বিতীয় সন্তান আসন্ন। আমি যখন বসতে যাচ্ছি আমার চেয়ারের দিকে। নিউজ এডিটর তুড়ি মেরে ডাকলেন আমাকে, ‘এই এদিকে এস’; কিছু একটা হল আমার ভেতরে। রাগে জ্বলে উঠলাম। প্রথমে উপেক্ষা করলাম, তারপর দ্বিতীয়বার যখন গলা তুলে ডাকলেন উনি, আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। পালটা চিৎকার করে বললাম, “কী মনে করেন আপনি, অফিসটা একটা পানশালা?”

    আবছা মনে আছে একটা পেপারওয়েট তুলে ছুঁড়তে যাচ্ছিলাম আমি, একজন সহকর্মী আমাকে ধরে আটকান। আরেকজন আমাকে জুলিয়েট মিশেলের একটা বই নিয়ে জোরে হাওয়া করতে থাকে। অনেক বছর পরে, যখন আমি দ্য টেলিগ্রাফ-এ যোগ দিয়েছি, সহকর্মীরা বলেছে, নিউজ এডিটরের দিকে আমার পেপারওয়েট ছোঁড়ার কথা সবাই শুনেছে। আমি ছুঁড়িনি শেষপর্যন্ত, যদিও সত্যি সত্যিই ছুঁড়তে চেয়েছিলাম সেদিন। দ্বিতীয়বার আমি পদত্যাগের চিঠি দিলাম, এবং দ্বিতীয়বার অভীকবাবুর কথা শুনে থেকেও গেলাম। তিনি বলেছিলেন ব্যাপারটা তিনি নিজে দেখছেন এবং তিনি এটা নিয়ে কড়া পদক্ষেপ নেবেন। নিউজ এডিটরকে ডিটক্সিফিকেশন-এ পাঠিয়ে দেওয়া হল।

    যে চার বছর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এ ছিলাম, আমি ভেতর থেকে বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ ছিলাম এবং শোধ নেওয়ার কথা ভাবতাম বারবার। বেকার থাকার ভয় ছিল, এবং একইসাথে প্রতিদিন অফিসের জন্য তৈরি হওয়ার সময় খুব খারাপ লাগত, এটা ভেবে ভয় হত যে না জানি কি অপেক্ষা করছে আজকের দিনটায়। নিজেকে চিনতে পারতাম না। আমার দুরবস্থা দেখে আমার স্বামী বারবার চাকরি ছেড়ে দিতে বলত, আশ্বাস দিত আমাদের বেড়ে চলা সংসারের দায়িত্ব ও একাই নিতে পারবে। শেষপর্যন্ত আমি ম্যাটারনিটি লিভে অফিস যাওয়া বন্ধ করলাম এবং তারপর ওই সংগঠনে আর কোনোদিন ফিরিনি। আমি বাচ্চার যত্ন নেওয়া ইত্যাদি অজুহাত দিয়েছিলাম, কিন্তু সত্যিটা হল আমার মনে হত আমার ওপর কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে, অসহায় লাগত। ওই দিনগুলোর একটা স্মৃতি রয়ে গেছে ভেতরে, শেষবার যখন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ছেড়ে আসছি, আর কখনও ফিরবনা ভেবে নিয়ে, ডেপুটি নিউজ এডিটর সত্য সাঁই বলেছিলেন, “আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি, আমি হেরে গেছি, আমাকে ক্ষমা কর।” ধন্যবাদ, সত্যদা।

    আমি প্রথাগত চাকরির চেষ্টা করিনি বহুবছর, এই ভয়ে যে সেখানেও এরকম হেনস্থার মুখোমুখি হতে হবে। এমনকি দ্য টেলিগ্রাফ, ওই একই মিডিয়া গ্রুপের আরেকটা কাগজ, সেখান থেকে যখন চাকরির প্রস্তাবটা এল, প্রথমদিকে আমি সেটা নেব কি না নিশ্চিত ছিল না। যদিও, সুমীর লাল, ওইসময়ে টেলিগ্রাফের এডিটর এবং আমার চেনা মিডিয়ার একজন অন্যতম সুন্দর মানুষ, নিজে আমাকে আশ্বস্ত করেন যে টেলিগ্রাফের পরিবেশ “অন্যরকম” এবং আমাকে “ওইরকম জিনিসের” মুখোমুখি কখনই হতে হবে না। তিনি কথা রেখেছিলেন।

    টেলিগ্রাফে যোগ দেওয়ার আগেই যদিও আমি সবকিছু ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেছিলাম। বুঝেছিলাম, ওই নিউজ এডিটর এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের আমার জীবন ধ্বংস করতে দেওয়াটা একটা মস্ত বড় ভুল। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরেও একধরনের প্রতিহিংসা, রাগ প্রতিনিয়ত ওই নিউজ এডিটরের কথা মনে করাত - সেই চিন্তার কবল থেকে আমাকে নিজেকে মুক্ত করতেই হত। যদি আমার সংগঠন আমার জন্য সুবিচার না করতে পারে, আমাকে নিজেকেই সেই সুবিচার করতে হবে নিজের প্রতি – নিজেকে সারিয়ে তুলতে হবে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দেওয়ার কয়েক বছর আগে পুলিশ হেফাজতে খিদে আর অত্যাচারের রুক্ষ, হতাশ দিনগুলো থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম নিজেকে; তাহলে এখন যখন আমি বন্দীও নই এবং কোনও পুলিশিই আমার ভেতরটা ভেঙে দিতে পারেনি, আমি কেন ভেঙে পড়ব? এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আমি জীবনের একটা নতুন পর্যায়ে পা দিলাম, আমার সঙ্গে আমার ভালোবাসার মানুষ, হাসিখুশি সন্তানেরা এবং অনেক অনেক কমরেড, বন্ধু, আত্মীয় যারা সবাই আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে। আরও একটা জোরের জায়গা, নতুন করে দেখার জায়গা তৈরি হল যখন নারী আন্দোলনে আরও বেশী করে জড়িয়ে পড়লাম আমি। বুঝলাম, মেয়েদের ওপরে নির্যাতনের লাগাতার ঘটনাগুলোরই একটা অংশ যৌন হেনস্থা। নির্যাতিতা, অসহায় মেয়েগুলো যখন সচেতনা-য় সাহায্যের খোঁজে আসত, ওদের কাছে পৌঁছে গিয়ে আমি নিজেকে সুস্থ করে তুলতে পেরেছিলাম। অফিস রাজনীতির বদ্ধ দুনিয়া থেকে বেরিয়ে মন দিতে পেরেছিলাম আরও বড়, আমার ব্যাপ্ত সামাজিক সমস্যার পরিসরে।

    একদিন, আমি তখন টেলিগ্রাফে, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর নিউজ এডিটর অফিসে ঢুকলেন। আমি ওনার মুখের দিকে তাকালাম, অবাক হলাম দেখে যে আমার আলাদা করে কিছুই মনে হল না। যে লোকটার ব্যবহারে অফিস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম, তার প্রতি কোনরকম বিতৃষ্ণাও নেই এমনকী। সহকর্মীদের অবাক করে দিয়ে, আমি ওনার সাথে গল্পগুজব করলাম – এমনকী হালকা হাসিঠাট্টাও। যে ভীতি আর শঙ্কা জড়িয়ে ছিল ওনার সঙ্গে, সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম আমি। আমি জিতে গেছিলাম।

    পুনশ্চ : বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর নিউজ এডিটর এবং বিজনেস ওয়ার্ল্ড –এর এডিটর প্রয়াত হয়েছেন। আমি তাঁদের নাম করছি না।

    [মূল ইংরাজি লেখাটি অক্টোবর ২০১৮-য় নেটওয়ার্ক অফ উইমেন ইন মিডিয়া, ইণ্ডিয়া (NWMI) এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে]

    অনুবাদ : চান্দ্রেয়ী দে

     
     



    Tags
     



    Comments (4)
    • এই লেখাটি পড়ে মনে হয়েছে যে ,অতীত জন সমাজ নারীদের যৌন হেনস্থার যন্ত্রনা বোঝানোর অবকাশ দেয়নি , কিন্তু বর্তমান জন সমাজ নারীদের হেনস্থার যন্ত্রনা বোঝার অনেক সুযোগ তৈরী করেছেন। কিন্তু অভাবনীয় ও নিরাপদ জায়গায় মহিলাদের যৌন হেনস্থার স্বীকার হতে হয় ।এই তিনের দশকে দাঁড়িয়ে রাজশ্রী দাশগুপ্ত মহাশয়ার প্রতিবাদ করাটাই খুব ভালো লেগেছে।

    • লেখাটি পড়ে জানতে পারলাম যে – মদ খাওয়ার অভ্যাস ছিল বলে সে যৌন হেনস্থা করত। মদ খাওয়া কেবলই অজুহাত , কোন কারন নয়। লেখাটি পড়ে ভালো লাগল। স্কুল ,কলেজে মেয়েদের কাছে এই লেখাগুলি পৌঁছে গেলে ভালো। তারা সচেতন হটে পারবে।

    • এই লেখাটিতে জানা যায় যৌন হেনস্থা যে সময়ে হয়েছিল সেই সময়ে মানুষের মধ্যে যৌন হেনস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারনা ছিল না । এখনকার গ্রামের সাধারন মানুষের মধ্যে ও লক্ষ্য করছি যৌন হেনস্থা বিষয়টি নিয়ে সকলের মধ্যে স্পষ্ট ধারনা নেই । কিন্তু ওই সময়ে ওনার মধ্যে যে স্পষ্ট ধারনা তৈরি হয়েছিল এবং তিনি তখন ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছেন , এটি জানতে পেরে অবাক হচ্ছি এবং ভাল লাগছে যে তিনি এখন তা প্রকাশ করেছেন বলে।

    • রাজশ্রী দাশগুপ্ত মহাশয়া তিনের দশকে এইরকম এক পরিস্থিতির স্বীকার হয়েও নিজেকে দৃঢ় রেখেছেন, পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে এবং যৌন হেনস্থার স্বীকার হওয়া মেয়েদের সাথে কথা বলে নিজে আরও শক্তি পেয়ে পরে সেই মানুষটির সাথে স্বাভাবিক আচরন করতে পেরেছেন। এবং তিনি তা তাঁর লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছেন। এই ধরনের লেখা পড়লে যৌন হেনস্থার স্বীকার হওয়া মেয়েরা নিজেদেরকে শক্ত রেখে, লজ্জা কাটিয়ে প্রতিবাদী হতে পারবে বলে আমার মনে হয়।

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>

     



    তথ্য নীতি | Privacy policy

 
Website © and ® by Ebong Alap / এবং আলাপ, 2013-24 | PRIVACY POLICY
Web design & development: Pixel Poetics