প্রতিবন্ধী নারীকথা : একটি গল্প সিরিজ ২
0 205মিতালীর বয়স এখন তিপ্পান্ন বছর৷ মিতালী থাকেন মধ্য কলকাতার একতলা এই বাড়িতে৷ জন্মানোর সময় অক্সিজেনের অভাব হওয়ায় মিতালী জন্ম থেকেই খানিকটা পিছিয়ে পড়া৷ মায়ের মুখে মিতালী শুনেছেন যে শিশু বয়সে হাঁটাচলা, কথাবার্তা সবকিছুই সে আর সব বাচ্চাদের থেকে দেরি ক’রে শিখেছে৷ সেই কারণে অবশ্য মিতালী বাবা-মা-র আদর থেকে বঞ্চিত হননি, বরং তাঁরা অতিরিক্ত যত্ন করেছেন৷ বয়সের তুলনায় একটু দেরি ক'রে হলেও স্কুল-কলেজের পড়াশুনা করা ইত্যাদি সবই মিতালী করতে পেরেছেন৷ অনেক বড় হওয়ার পর মিতালী জানতে পেরেছেন তাঁর যে প্রতিবন্ধকতা আছে, সেই প্রতিবন্ধকতার পোশাকি নাম সেরিব্রাল পালসি৷ তাঁর এক হাত ও এক পা আড়ষ্ট হওয়ার জন্য মিতালীর চলন খুব ধীরগতি, কাজেই রাস্তাঘাটে বা কলকাতার বাসে উঠতে গেলে তাঁকে খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়৷ তখন আর সেরিব্রাল পালসি বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত-এর মত পোশাকি নামগুলো কারুর মনে থাকে না—বাসের লোকজন ‘অফিস টাইমে খোঁড়া মেয়ে রাস্তায় বেরোয় কেন’, প্রশ্ন তোলে প্রায়৷ তবে হাঁটার ভঙ্গি আর সব মহিলার থেকে আলাদা বলে তিনি ভাবনাচিন্তার দিক থেকেও অনেক পিছিয়ে, এ কথা পরিবার, প্রতিবেশী, মিতালীর সহকর্মীরা সকলেই মনে করেন৷ মিতালীর বাবা-মা মারা গেছেন, রক্তের সম্পর্ক বলতে নিজের ছোট ভাই৷
মিতালীর ভাই মিতালীর থেকে বছর দশেকের ছোট৷ শৈশবে সে দিদির সঙ্গে খেলাধূলা করা বা একসাথে ইস্কুল যাওয়া সবই করেছে৷ কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর থেকেই তার মনে দিদিকে নিয়ে অনেক সমস্যা৷ একে তো বন্ধুরা দিদিকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তারপর সে শুনেছে প্রতিবন্ধী মেয়েদের বিয়ে হয় না৷ সারা জীবন ভাইয়ের সংসারে ওরা থাকে। আরও বড় সমস্যা হল যখন মিতালী ও তাঁর ভাই কলেজে পড়েন, সেই সময় তাঁদের বাবা মারা গেলেন৷ যে বাড়িতে তাঁরা থাকেন, সেটি বাবার সম্পত্তি৷ মিতালীর মা সবার সমক্ষেই বলেন, আমার মেয়ের তো বিয়ে হবে না, এই বাড়িটা তাই মেয়ের নামেই লিখে দেব৷ মিতালীর ভাইয়ের মনে বিদ্রোহ জেগে ওঠে, সম্পত্তি দিদি পেলে সে কী পাবে? প্রতিবন্ধী দিদির বাড়িতে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভাল বলে সে মাকে জানায়৷ কাজেই মা সম্পত্তি নিয়ে আর কোনও কথাবার্তা বলেন না৷
কিন্তু মিতালীর মনে অন্য প্রশ্ন জাগে৷ তিনি বাবা-মা-র বাড়িতেই থেকে যাবেন একথা ভাবা হচ্ছে কেন? তাঁর পাড়ার সমবয়সী মেয়েরা তো বিয়ে ক’রে অন্য বাড়ি চলে যায়৷ তাঁরও তো মনে বিয়ের শখ আছে৷ কিন্তু মা যেন তাঁর বিয়ে হতে পারে এটা মানতেই পারেন না৷ মিতালী কলেজের এক বন্ধুকে একথা জানিয়েছিলেন৷ তাঁর বন্ধু অত্যন্ত করুণার সঙ্গে তাঁকে বুঝিয়েছে, “যে মেয়ে প্রতিবন্ধী, তাদের বিয়ে হয়না—কোনও ছেলেই তাকে পছন্দ করবে না৷ তাছাড়া মিতালীর ডান হাত, ডান পা, দুটোতেই খুঁত, সে সংসারের কাজ করবে কী করে?”— বন্ধুর কথা শুনে মিতালী অবাক হন, ভাবেন, কোনও ছেলেই পছন্দ করবে না? তবে যে ভাইকে পড়াতে আসে যুবকটি, সে যে মিতালীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়! তবে কিনা খুঁতো মেয়ে তো, কোনও ছেলে তাকাল বা ইশারা করল, সে কথা নিয়ে কারুর সঙ্গে কথা বলতে নেই, তা মিতালী জেনে গেছেন৷ কলেজের যে সব মেয়েরা তাঁর সঙ্গে ভাল ক’রে কথা বলেন, তাঁরা আসলে তাঁকে দয়া করেন, সেই অনুভূতি তাঁর এসেছে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে৷
অতএব যৌবন এভাবেই অতিক্রান্ত হয়৷ মিতালী কলেজ পাশ ক’রে কিছুদিন বাড়িতে বসে থাকেন৷ তারপর হঠাৎ একটি এনজিও-তে চাকরি পান৷ ইতিমধ্যে মা মারা গেছেন, ভাই বিয়ে করে সংসারী হয়েছে৷ মিতালী যে এনজিওতে চাকরি পেয়েছেন সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিয়ে নানা কাজ হয়৷ যদিও অ-প্রতিবন্ধী মানুষরা এনজিওটি চালান এবং তারাই অনেকটা বেশি বেতন পান সেখানে৷ কিন্তু মিতালী জানেন এইসব নিয়ে প্রতিবাদ ক’রে লাভ হবে না৷ বরং তাঁর চাকরিটি চলে যেতে পারে৷ অথচ চাকরিটি তাঁর বড়ই দরকার৷
তাঁর ভাই চেষ্টা করছে বাড়িটি প্রোমোটারের কাছে দিয়ে দেওয়ার, সে সল্টলেক অঞ্চলে ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে আগ্রহী৷ মিতালী কেন এই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে আছেন, ভাই, ভাই-বউ রোজই কথা শোনায় তাঁকে৷ মিতালী একবার চেষ্টা করেছিলেন ওয়ার্কিং উইমেনস হোস্টেলের খবর করার৷ তাঁর অ্যাপ্লিকেশন মঞ্জুর হলেও হোস্টেলের সুপার যখন তাঁকে সামনাসামনি দেখে জানতে পারেন তাঁর প্রতিবন্ধকতা আছে, সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন এখানে চেষ্টা না করে মিতালীর প্রতিবন্ধীদের হোমে গিয়ে থাকা উচিত৷ কিন্তু যে হোমগুলিতে থাকে নিরুপায়, উপার্জনহীন মেয়েরা, সেখানে মিতালীর স্থান হবে কেন? সেই অর্থে তিনি গৃহহীন নন, উপার্জনহীনও নন৷
যদিও মিতালী জানেন না তাঁর ‘গৃহ’ আর কতদিন তাঁর থাকবে৷ কারণ প্রোমোটারের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় পাকা, ভাই জানিয়েছে প্রোমোটার একটি ফ্ল্যাট দেবে এবং সেটিতে অবশ্যই ভাই ও তার পরিবারের অধিকার৷ অবিবাহিত মেয়েদের গৃহ বা সংসার থাকে কি না মিতালী ঠিক বুঝতে পারেন না৷ বাবার বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেলে তিনি কোথায় থাকবেন জানা নেই তাঁর৷ শ্বশুরবাড়ি গেলেই সব মেয়েরা সুখী থাকে তা নয়, একথা মিতালী জানেন৷ কিন্তু তাঁর তো শখ ছিল বিয়ে করার, কোনও পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখার৷ বাড়ি তার নামে লিখে দিয়ে যাননি বলে মিতালীর মনে মা-র ওপর রাগ নেই, কিন্তু রাগ আছে তাঁর বিয়ের চেষ্টা করেননি বলে৷ মিতালী তার এনজিওতে চাকরিসূত্রে জেনেছেন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের “Right to Home and Family” এখন ভারতে আইন-স্বীকৃত৷ কিন্তু মিতালীর বাড়ি আর পরিবার কোনটি সে কথা তাঁর নিজেরই কেমন যেন গুলিয়ে যায়৷ তবুও তিনি এনজিও-র কাজটি খুব মন দিয়ে করেন৷ তাঁর আশা আছে ভবিষ্যতে তাঁর মত আরও মিতালীরা পারবে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো ভাঙতে, সমাজ ও পরিবারের মধ্যেই নিজের জন্য অন্য পরিচিতি তৈরি করে নিতে।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply