রূপকথায় মেয়েদের চুপকথা
0 560‘হিংসেয় ছোট রানি বুক ফেটে মরে গেল।’
‘ক্ষীরের পুতুল’-এর এই শেষ বাক্যটি কোন বাঙালি শিশুই বা ভুলতে পেরেছে? এই বাক্যটি আমার সমস্ত শৈশব অধিকার করে ছিল। এ কেমন হিংসে, যার ভারে মানুষ বুক ফেটে মারা যায়? কেউ ফাঁসি দিল না, শূলে চড়াল না, হেঁটোয় কাঁটা, মাথায় কাঁটা দিয়ে পুঁতে রাখল না, একজন লোক নিজের হিংসের জ্বালায় নিজেই বুক ফেটে মারা গেল! এমন আশ্চর্য ঘটনা ভাবা যায়? ছোটরানির এহেন পরিণতিতে যৎপরোনাস্তি খুশি হয়েছিলাম একথা বলা বাহুল্য। খেয়ালই করিনি, রূপকথা, যাকে নেহাতই নিরীহ শিশুপাঠ্য ভাবা হয়, তাতে এমন হিংসার ছড়াছড়ি - যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে হিংসার বিষ-পুঁটুলি করে রাখা হয়েছে মেয়েদেরই। আর এই হিংসার সংঘটন অনেক সময়ই শিশুজন্মকে কেন্দ্র করে। রাজ পরিবারে রাজার বহু রানির মধ্যে বিশেষ কেউ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে, তাকে যেন তেন প্রকারেণ প্রতিহত করার জন্য সতীন বা জা-দের ব্রিগেড (প্রায়ই সংখ্যাটা সাত, কেন কে জানে!) বিশেষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর নবাগত সন্তান বা সন্তানেরা প্রায়ই পাচার হয়ে যায় অন্য কোথাও - ফেলে আসা হয় গভীর অরণ্যে অথবা তাদের পুঁতে ফেলা হয় ছাইগাদায়। তারপর, ওয়ান ফাইন মর্নিং তারা সেই ছাইগাদায় সাত ভাই চম্পা (এখানেও সাত!) হয়ে ফুটে ওঠে। কবে পারুল বোন এসে তাদের উদ্ধার করবে এই প্রতীক্ষায়। কিন্তু ততক্ষণে তো রাজামশাইকে কুকুর-বেড়ালের ছানা দেখানো হয়ে গেছে, আর আদরের ছোটরানির পেটে এমন মনুষ্যেতর প্রাণী ছিল দেখে রাজামশাই তাকে দূর দূর করে রাজ্য থেকে তাড়িয়েও দিয়েছেন। রূপকথার রাজারা অনেকটা হিন্দি সিনেমার পুলিশের মতো – পিকচার যখন আর প্রায় বাকি নেই, তখন তাঁদের বোধোদয় হয়। খেদিয়ে দেওয়া মেয়ে যখন নেমন্তন্ন করে পাতে মণি-মাণিক্য সাজিয়ে খেতে দেয়, তখনি তাঁরা বুঝতে পারেন, মণি-মাণিক্য যেমন খাওয়া যায় না, তেমনি মানুষের পেটে কুকুর বেড়াল হতে পারে না।
অবিশ্যি রাজামশাইয়ের এই বুঝতে না পারার দায় কিন্তু তাঁর নয়, কুচক্রী নারী বা নারীবাহিনীর। তারা কখনও সুয়োরানি, কখনও রাক্ষসী রানি, কখনও ডাইনি বুড়ি। সেই ডাইনি বিষের নাড়ু বানাতে জানে, গভীর জঙ্গল থেকে জড়িবুটি খুঁজে আনতে পারে। আমরা ভুলে যাই, এরা আসলে বিষবিদ্যার আদি জননী। বশীকরণ, জাদুবিদ্যা, তুকতাকের সাধিকারা তো সমাজে চিরকালের ভ্রষ্টা। অথচ বন্ধ্যাত্ব নিবারণ, যৌনক্ষমতা বাড়ানো, পরনারী বা পরপুরুষ বশের কলাকৌশলের জন্যে রাষ্ট্র ও সমাজ বারবারই তাদের শরণাপন্ন হত। ছোটবেলা থেকে রূপকথার এইসব ডাইনি বুড়িদের প্রতি ভয় ও ঘৃণায় বড় হতে হতে আমরা খেয়ালই করিনি এই মেয়েদের অনেকেরই বিষ, ভেষজ, শারীরবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতো। অনেক সময় অনুমান-নির্ভর প্রয়োগ থেকে হিতে বিপরীত ঘটতো ঠিকই, কিন্তু বেশ্যালয়ের মতো সমাজের অনেক জরুরি কিন্তু গোপন বা নিন্দিত কাজের দায়িত্ব তারা পালন করেছে যুগ যুগ ধরে। আর এরাই বোধহয় অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীর প্রথম উদাহরণ।
পরে 'চণ্ডীমঙ্গল'-এ পাই রম্ভাবতীর বশীকরণ ঔষধ সংগ্রহের অনুপুঙ্খ বর্ণনা-
ঔষধ করিয়া রম্ভা ফিরে বাড়ি বাড়ি
দোছট করিয়া পরে তসরের শাড়ী
পূজার মহিষের আনে নাসিকার দড়ি
দুর্গার প্রদীপে করে কজ্জ্বলের বড়ি
সাধুর কপালে যবে দিব রঙ্গবসু
খুল্লনার হবে সাধু পঞ্জরের পশু
আনিল পুড়াতি গাছ হাই হামলাতি
কবরের তুলিয়া আনে কালিমা বিছাতি
এর অগ্রপথিক ক্ষীরের পুতুলের ডাকিনী ব্রাহ্মণী, দুয়োরানিকে মারবার জন্যে সুয়োরানি যার শরণ নিয়েছিল। ডাকিনী “...বনে বনে খুঁজে খুঁজে ভর সন্ধেবেলা ঝোপের আড়ালে ঘুমন্ত সাপকে মন্ত্রে বশ ক’রে, তার মুখ থেকে কালকূট বিষ এনে দিল। ...”
রূপকথার পুনর্পাঠ করলে দেখা যাবে, রাজারা কেবল যুদ্ধু করেন, রাজপুত্তুররা কোনও দুরূহ কাজে তেপান্তর পার হন, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী অক্লান্তভাবে তাদের সাহায্য করে যায়; কিন্তু রানি বা রাজকন্যাগুলি কোনও কর্মের না। তাঁরা জানেন কেবল বিকেলে গা ধুয়ে রেশমি শাড়ি পরে ছাদে বা বাগানে বেড়াতে আর রাজা বা অচিন দেশের রাজকুমারদের জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে। দুনিয়াদারির কোনও খবরই তাঁরা রাখেন না, বিপদে পড়লেই তাঁরা ডাকিনী ব্রাহ্মণীদের মতো প্রান্তিক মানুষজনের শরণাপন্ন হন। তারাই যেন বিকল্প ক্ষমতার উৎস। যদিও তারা কতটা যে সমাজছাড়া, এমনকি ঘৃণ্য ও ব্রাত্য, তা তো বোঝা যায় পথের পাঁচালী-র আতুরী ডাইনির পরিচ্ছেদ পড়লে। সে নাকি কচি ছেলেদের রক্ত চুষে খায়, তাদের প্রাণ কচুপাতায় বেঁধে জলে ডুবিয়ে রাখে। অপুর ভয় দেখে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা হতদরিদ্র আতুরী বুড়ি ভেবেছিল ‘মুই মাত্তিও যাইনি, ধত্তিও যাইনি- কাঁচা ছেলে, কি জানি মোরে কেন ভয় পালে সন্দেবেলা? খোকাডা কাদের?...’
আর আছেন সন্ন্যাসীরা, যারা ঠিক মুহূর্তে হাজির হন সন্তানহীন রাজার মুখে হাসি ফোটাতে। একটা মন্ত্রপূত আম বা অজানা গাছের শিকড় নিয়ে। কিন্তু সেই আম বা শিকড় কেউ কোনওদিন রাজাকে খেতে দেখেছেন? যেমন ‘মর্দ কো কভি দর্দ নেহি হোতা’ তেমনি রাজামশাইরা কখনও বন্ধ্যা হন না। শিল-ধোয়া জল শুধু রানিদের জন্য।
রূপকথার গল্পে দেখি রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। তবু তাঁর মনে সুখ নেই। কারণ তাঁর একটিও সন্তান নেই। একের পর এক পত্নী ঘরে এনেও যে সন্তানের মুখ দেখেন না রাজা, তার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজাই তো বন্ধ্যা, আর তাঁর বন্ধ্যাত্ব ঢাকতেও হরেক কৌশল। ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের বিষয়টি চাপা দিতে রানিদের অক্ষমতার প্রচার আর তার নিরাময়ে নানান টোটকা। হয়ত মৃগয়ায় গিয়ে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা। তিনি রাজার হাতে তুলে দিলেন একটি মন্ত্রপূত আম বা দুর্লভ শিকড়। রাজা নাচতে নাচতে এসে তা দিলেন সাত রানিকে, বললেন সবাই মিলে ভাগ করে খেতে। হিংসুটে বড় রানিরা নিজেরা সব চেটেপুটে খেল আর বেচারি ছোটরানির জন্যে পড়ে রইল শিল-ধোয়া জলটুকু। ‘কলাবতী রাজকন্যা’-য় দেখি ছোটরানির কপালে সেটুকুও জুটল ন’ রানির দাক্ষিণ্যে। ‘চল বোন ছোটরানি, শিল নোড়াতে যদি একাধটুকু লাগিয়া থাকে, তাই তোকে ধুইয়া খাওয়াই। ঈশ্বর করেন তো, উহাতেই তোর সোনার চাঁদ ছেলে হইবে।’ রূপকথার হিংসের রাজত্বে এই দুই সতীনের সখ্যটুকু এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতো।
এই ছবিটুকু ছাড়া রূপকথা তো বড় নির্মম, মেয়েদের কুটিলতা তুলে ধরে বারবার। সেখানে সৎ মাকে প্রায় ডাকিনী করে আঁকা হয় – দেশ হোক বা বিদেশ, সব রূপকথায় তাই - স্নো হোয়াইট, সিন্ডারেলা থেকে আমাদের সাত ভাই চম্পা বা শীত বসন্ত। শীত বসন্তের সৎমা ছোটরানি অগ্নিমূর্তি হয়ে বলেন ‘ শীত বসন্তের রক্ত নহিলে আমি নাইব না’। অমনি শালগ্রাম শিলার মতো নির্বিবাদী রাজামশাই জহ্লাদকে ডেকে আদেশ দেন শীত বসন্তকে কেটে রানিমাকে রক্ত এনে দিতে।
আমরা যারা আজ বাচ্চাদের হিংস্র মাচো অনলাইন গেম খেলতে দেখলে রেগে যাচ্ছি, তারা কিন্তু কক্ষনো প্রশ্ন করিনি - শিশুপাঠ্য রূপকথায় এত রক্ত কেন? ‘উলঙ্গ রাজা’র মতো ভুলেও বলিনি ‘ও রাজামশাই তোমার সিমেন কাউন্ট করিয়েছ? যতই নিত্য নতুন বিয়ে করে আনো না কেন, তুমি সন্তানের মুখ কোনও দিন দেখবে না, কারণ তুমিই বন্ধ্যা’। অবন ঠাকুরের মায়াময় গদ্যে মুগ্ধ হয়ে খেয়ালই করিনি ষষ্ঠী ঠাকরুনের ষষ্ঠীতলা কেন কেবল ছেলের রাজ্য? সেখানে কেবল ছেলে – ‘ঘরে ছেলে, বাইরে ছেলে, জলে-স্থলে পথে-ঘাটে, গাছের ডালে, সবুজ ঘাসে যেদিকে দেখে সেইদিকেই ছেলের পাল, মেয়ের দল’ এই ‘মেয়ের দল’ দু’টি শব্দ আছে বটে, কিন্তু তারা প্রায় অদৃশ্য, একেই কে যেন বলেছে ‘জিরো ভিজিবিলিটি’।
ঠাকুরমার ঝুলির শেষে একটি চমৎকার ছড়া রয়েছে।
খোকন সোনা চাঁদের কোণা
খোকার মাসি এল দেশে
আকাশের চাঁদ পাতালের চাঁদ
ধরে এনেছে!
দুই পাড়ে রে রূপের সাগর
গলায় আছে ধান-
মায়ের কোলে শোন রে জাদু
ঘুম পাড়ানি গান।
ধূলার বড় ভাগ্যি, খোকন গায়ে মেখেছে
অর্থাৎ দিনের শেষে ঘুম পাড়ানি গান বা রূপকথার ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ও যাদুমণি বা খোকন সোনারাই। সেখানে মেয়েরা চিরকাল রূপের ডালি নিয়ে জানলায় বসে তাদের দীর্ঘ চুল ঝুলিয়ে দিয়েছে, আর সে চুল বেয়ে উঠে এসেছে পিতৃতন্ত্র।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply