''তোমাকে কেন নেব'' : বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা
0 337‘তোমাকে কেন নেব?’ - এই প্রশ্নটা যে কত নিয়োগকর্তার মুখে চোখে লেখা থাকে কখনো উচ্চারিত কখনো অনুচ্চারে, তা মেয়েরা জানে। এমনকী, ‘চলাচল’ সিনেমায় দেখেছি কিশোর মন্টুও মেয়ে-মাস্টারের কাছে পড়বে না বলে বেঁকে বসেছিল, সে মেয়ে যতই ডাক্তার হোক!
চাকুরিপ্রার্থী মেয়েরা, বিশেষ করে বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্নাতক মেয়েরা যখন তাদের জন্য বেঁধে রাখা তথাকথিত ‘নিরাপদ’ দিদিমণিগিরি কিংবা তথ্য-প্রযুক্তির ঠান্ডা ঘরের আরাম ছেড়ে ইন্ডাস্ট্রির ‘পুরুষালি’ এলাকায় পা বাড়ায়, তাদের তখন শুনতে হয় ‘তোমাকে কেন নেব?’... মানে, ‘একটা ছেলেকে না নিয়ে তোমাকে কেন নেব?’
এ প্রসঙ্গেই আমাদের মনে পড়বে, কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার সময় বিরুদ্ধতার ঝড় উঠেছিল। ডঃ রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র থেকে বৈদ্যনাথ মন্দিরের পূজারীরা বা মেডিকেল সার্ভিসেস-এর পদস্থ অফিসাররা - কে বাধা দেননি? ভদ্রঘরের মেয়েদের ডাক্তারি পড়া! সে নেহাতই সৃষ্টিছাড়া কাজ। খবরের কাগজেও বিস্তর লেখালেখি হল এ নিয়ে। মাথাব্যথার কারণ তো একটা নয়, অনেক - মেয়েরা কী করে নাইট ডিউটি করবে? পুরুষ শিক্ষকরাই বা কীভাবে মহিলা ছাত্রীদের সামনে অ্যানাটমির ক্লাস নেবে? গর্ভাবস্থায় বিবাহিতা মেয়েরা কেমন করে ক্লাসে হাজিরা দেবে? গর্ভাবস্থায় তারা কীভাবে রুগী দেখবে?...
এসব চিন্তায় মাথা ঘামিয়েছিল সমাজ। আশ্চর্য কি, বিলেতের ডিগ্রি নিয়ে আসা নামজাদা ডাক্তার কাদম্বিনীকেও এই সমাজ বরাবর ব্রাত্যই করে রেখেছিল। নিমন্ত্রণ বাড়িতে নিজের এঁটো নিজেকেই পাড়তে হয়েছিল তাঁকে, কারণ ধাইমানীর এঁটো পাড়তে কাজের লোকেরাও রাজি ছিল না। আর মেয়েদের ধোপার হিসেব আর দেবদেবীর শ্লোক পাঠ করার ওপরে শিক্ষা দিতে এই সমাজের তো বরাবরের অনীহা। বিশেষ করে বিজ্ঞান, কারণ মেয়েদের পক্ষে তা ‘অমঙ্গল’!
- “প্রকৃত শিক্ষাও নারীর পক্ষে অমঙ্গলের কারণ। কেননা, ইহা দ্বারা নারীর পুত্র প্রসবোপযোগী শক্তিগুলির হ্রাস হয়। বিদুষী নারীগণের বক্ষদেশ সমতল হইয়া যায়, এবং তাহাদের স্তনে প্রায়ই স্তন্যের সঞ্চার হয় না। এতদ্ভিন্ন তাহাদের জরায়ু প্রভৃতি বিকৃত হইয়া যায়...”
(নারীধর্ম, ‘বেদব্যাস’, নীলকণ্ঠ মজুমদার)
আমাকেও শুনতে হয়েছিল। একটি অত্যন্ত নামী আধা-সরকারি মুদ্রণ সংস্থা - কর্মী সংখ্যা প্রায় সাতশ’, কর্মীদের অধিকাংশই বয়স্ক, সেইরকমই প্রাচীন মেশিনপত্র - তাদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ তে বছর বাইশের এক নেহাতই অর্বাচীন মেয়েকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘তুমি কেন ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে চাইছ’? প্রশ্নটা আসলে, ‘কেন তুমি খামোখা তুলনায় আরামদায়ক ও মেয়েলি চাকরি ছেড়ে ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে চাইছ?’
এর উত্তরে যা বলেছিলাম, তা এখনো মনে আছে।
- ‘আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ আ ফিল অব দ্য ইন্ডাস্ট্রি’।
এমন উত্তরে ইন্টারভিউ বোর্ডে (যেখানে সবাই পুরুষ বলা বাহুল্য) কয়েক মুহূর্তের জন্যে হিরণ্ময় নীরবতা নেমে এল। তারপর কেমন বেখাপ্পাভাবে পরের প্রশ্নটা এল, ‘এখানে কাজ করতে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না? ইয়ে, মানে... এত ভারী মেশিন, ভারী ভারী কাগজের রোল, শপ ফ্লোরে এত আওয়াজ, মানে একটা ছেলে...’
প্রশ্নটা শেষ না করতে দিয়ে আমি বলে উঠি,
- ‘পোস্টটা তো ট্রেনি এঞ্জিনিয়ারের। তো একজন এঞ্জিনিয়ারের কাজ হচ্ছে ডিসিশন মেকিং, ডিজাইনিং আর কন্ট্রোল। তাই মেশিনের কন্ট্রোল প্যানেলটা ঠিক মতো জানলেই আমার চলবে। আর কাগজের রোল টানার জন্য হেল্পার আছে, কোন ছেলে এঞ্জিনিয়ারকেও তো সে রোল টানতে হয় না’।
অনেক পরে লেখা একটি গল্প ‘শিউপূজনরা’-তে ধরা আছে সেই অভিজ্ঞতা।
“...
আচ্ছা, একজন মেয়ে হিসেবে তোমার কি মনে হয় না, শপ ফ্লোরে কাজ করতে তোমার বেশ অসুবিধে হবে? ওয়ার্কার্স হ্যান্ডলিং, অনেক রকম টাফ সিচুয়েশন আসতে পারে, তাছাড়া তোমায় যদি নিই, তবে তোমার মতোই, ওদেরও মানে ওয়ার্কার্সদেরও একদম নতুন অভিজ্ঞতা হবে, একজন মেয়েকে মাথার ওপরে দেখার। আর তার প্রতিক্রিয়া কীভাবে আসবে, আমরা জানি না।’
রঞ্জনা চেষ্টা করে। কামিজ বা টি শার্টের ওপর অ্যাপ্রন জড়িয়ে তেল-গ্রিজ মাখে। একটা সারক্লিপ কি বল-বিয়ারিং আবিষ্কার ক’রে চমৎকৃত হয়। এবং হাড়ে হাড়ে বোঝে মেয়েদের জীবন দেখার ঐতিহ্য কত অল্প দিনের। সে যেভাবে দেখছে, তার মা দূরস্থান, তার পিসিও ভাবতে পারেনি। বাড়িতে বাল্ব কেটে গেলে দাদা পাল্টাবে এটাই পূর্ব-নির্ধারিত। সে হাত দিতে গেলে মা হাঁ হাঁ করে ওঠে ‘কারেন্ট খাবি, সরে যা’। তাই প্রতিটা জিনিসই তাকে প্রথম থেকে শিখতে হচ্ছে।”
চাকরিটা আমার হয়েছিল। তবে চাকরিটা হওয়া মানেই ‘দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার’ নয়। তখন ‘তোমাকে কেন নেব?’ প্রশ্নটা বদলে হয়ে যায় ‘তুমি এখানে কেন?’ সত্যি সত্যি আগাগোড়া মাচো এবং হিংস্র একটা পরিবেশে (অনেক জায়গায় লেডিস টয়লেট পর্যন্ত নেই) খাবি খেতে খেতে মেয়েটিরও একসময় মনে হয় ‘হেথায় তারে মানাইছে না, এক্কেবারে মানাইছে না গো’!
লেডিজ টয়লেট নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিনের ভাবনাও তখন উদয় হয়নি। শপ ফ্লোরে ছেলে এঞ্জিনিয়ার আর ছেলে মেশিনম্যানের বিড়ি আর খিস্তির মাঝে দাঁড়ানো মেয়েটির অবস্থা অশোকবনে চেড়ী পরিবেষ্টিতা সীতার মতই ভয়াবহ। অর্থাৎ চাকরি তো হল, কিন্তু এ চাকরি শেয়ালের বাড়িতে বকের নেমন্তন্নের মত একই সঙ্গে ট্রাজিক ও কমিক!
''...
মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত অ্যাসিস্টেন্ট ইনচার্জের হাত থেকে বিড়ি নিচ্ছে। শুভদীপ বলল ‘অ্যাই কাউন্টার দে’
একজন হেল্পার চাপা গলায় বলে
‘এই মেয়েছেলেটা থাকলে মাইরি শান্তিতে দুটো খিস্তিও দেওয়া যায় না!’
শুনে রাজ হাসছে হ্যা হ্যা করে। জয়ন্তর বিড়ির আগুনে আর একজন বিড়ি ধরায়, তারপর রাজ, শুভদীপ, বাসুদেব দাস, তারপর আকবর আলি, শিউপূজন..."
এর অবধারিত ফল ইন্ডাস্ট্রি ড্রপ আউট। শপ ফ্লোর থেকে নরম নিরাপদ পেশায় সরে আসা। ডাক্তার বা এঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে স্রেফ বাড়ি বসে থাকা মেয়েদের দৃষ্টান্তও প্রচুর পাওয়া যাবে।
নব্বইয়ের দশকে এই প্রশ্নগুলো উঠত। এখনও ওঠে। তবে সংখ্যায় কম। হার্ডকোর এঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে মেয়েদের কাজ করতে দিতে নিয়োগকর্তার অনীহা ছিল, তার সঙ্গে ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণ মানসিকতা। এই গল্পটা যে সময়ের, সেই সময়েরই এঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারের কয়েকটি মেয়ে একটি বিখ্যাত এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্লেসমেন্ট সেলে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ-এর ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে প্লেসমেন্ট অফিসার তাদের বলেছিলেন,
- ‘মা জননীদের তো দেখতে শুনতে ভালই, চাকরি না খুঁজে চটপট বিয়ে করে নাও’।
এই অবস্থা সামান্য হলেও বদলেছে। আমার সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ নব্বই জন ছেলের পাশে একটি মাত্র মেয়ে টিমটিম করত। এখন হার্ডকোর এঞ্জিনিয়ারিং-এ মেয়েদের সংখ্যাও আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু ছাত্রাবস্থার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের তফাত আকাশ পাতাল। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বিজ্ঞানের গবেষকদের মধ্যে মহিলারা এখনও এক তৃতীয়াংশও নন (২৮.৮%)। মার্কিন মুলুকে দেখা যাচ্ছে ১৯৬৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে বিজ্ঞান ও এঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক নারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা প্রতিফলিত হচ্ছে কি?
একেবারে টেকনোলজি জায়েন্ট বলা হয় যে সংস্থাগুলোকে তাদের দিকেই দেখা যাক।
২০১৫ সালের হিসেব বলছে, মাইক্রোসফট-এ টেকনোলজির কাজে আছে মাত্র ১৬.৬% মেয়ে, টুইটার–এ আছে ১০% আর গুগল-এ ১৭%। এর উত্তর খুজতে গিয়ে এলিজাবেথ গ্রেস বেকার বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। সংক্ষেপে বললে সেগুলো এইরকম-
- সঠিক শিক্ষার ও শিক্ষণের অভাব
- কনফিডেন্স গ্যাপ
- সাপোর্ট সিস্টেমের অভাব
- ওয়ার্ক প্লেস হ্যারাসমেন্ট
এরকম আরো আছে। দেখা গেছে আট বছরের প্রোগ্রামিং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি মেয়ে প্রায় নবিস একটি ছেলের তুলনায় কম আত্মবিশ্বাসী। এই আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্যে সম্ভবত তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ দায়ী। মেয়েটি যে কিছু পারবে তা তাকে কখনই বলা হয় না। যৌন লাঞ্ছনা, কুপ্রস্তাব এগুলো অন্য সব কর্মক্ষেত্রের মতো STEM পরিসরেও আছে। আর সাপোর্ট সিস্টেমে আছে ঠিক মেন্টরের অভাব।
একটি মেয়েকে যেকোনও জায়গায় কাজ পেতে যোগ্যতা ছাড়াও অন্য অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করতে হয়। বিজ্ঞান প্রযুক্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। স্রেফ মেয়ে বলে রাজেশ্বরী চ্যাটার্জি বা কমলা সোহনী ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, ব্যাঙ্গালোর থেকে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন; স্বয়ং সি ভি রমণ তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় আন্না মানিকে ডিগ্রিই দেয়নি। দর্শনা রংগনাথনকে চাকরি দেওয়া হয়নি তাঁর স্বামী একই প্রতিষ্ঠানে আছেন, এই অজুহাতে। রসায়নের স্নাতক সুস্মিতাকে মিলিটারিতে কারিগরি কাজ না দিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল কিচেনে, সেই অবসাদে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে।
আর এই ঘটনাগুলো রোজই ঘটে চলেছে কোথাও না কোথাও, এদেশে বা বিদেশে। মাঝে মাঝে বেশ কৌতুককর ঘটনাও ঘটে। ন্যানোমেকানিক্সের ওপর গবেষণারত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রা হজের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন একদল জাপানী বিজ্ঞানী। তাঁরা শান্তভাবে অপেক্ষা করছেন ডক্টর হজের জন্য। অথচ সামনেই তিনি বসে। তাঁরা ভাবলেন এই মহিলা ডক্টর হজ(যিনি নিশ্চয়ই একজন পুরুষ)-এর সুন্দরী সেক্রেটারি।
এর পরেও আশার কথা আছে। মেয়েদের বলা হচ্ছে গ্রোথ এরিয়া। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে নাকি ছেলেদের উৎসাহ বা যোগদান একদিকে কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে মেয়েদের সংখ্যা। হয়তো একই অনুপাতে নয়, তবে বাড়ছে। আর এইভাবেই মেয়েরা জিতে যাবে একদিন।
Tagsadolescence age of consent age of marriage caa child marriage corona and nursing covid19 Covid impacts on education domestic violence early marriage education during lockdown foremothers gender discrimination gender identity gender in school honour killing human rights intercommunity marriage interfaith marriage lockdown lockdown and economy lockdown and school education lockdown in india lockdown in school lockdown in schools love jihad marriage and legitimacy memoir of a nurse misogyny nrc nurse in bengal nursing nursing and gender discrimination nursing in bengal nursing in india online class online classes during lockdown online education right to choose partner school education during lockdown social taboo toxic masculinity transgender Women womens rights
Leave a Reply